পৃথিবীর অসুখ। যে অসুখে মরছে মানুষ। বড় হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। যে মিছিল ছড়িয়ে পড়ছে উত্তর গোলার্ধ থেকে দক্ষিণ গোলার্ধে খুব দ্রুত গতিতে। জেট গতিতে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের সামনে বড্ড অসহায় মানুষ। তার সামনে ধনী-দরিদ্র থেকে শুরু করে করপোরেট জগতের দাপুটে বস-কর্মকর্তা-কর্মচারী-পিয়ন, রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান সবাই অসহায়ের মতো অপেক্ষমাণ, নিরুপায়। কেউ জানছেন না কখন ডাক আসবে। প্রতিদিন কত মানুষের দরজায় এসে দাঁড়াচ্ছে মৃত্যু নামক অমোঘ চক্রযান।
Advertisement
মৃত্যুর মিছিলেও কী তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা! রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আপনি জেনে যাচ্ছেন করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি চীনে। ঘুম থেকে ওঠে টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখতেই দেখলেন উসাইন বোল্টের গতিকে হার মানানো মৃত্যুর মিছিলে চীনকে পেছেনে ফেলে দিয়েছে ইতালি! পাশের লেনে দৌড়াচ্ছে স্পেন!
করোনাভাইরাস একাকার করে দিয়েছে উন্নত-অনুন্নত-উন্নয়নশীল বিশ্বকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডা। মেক্সিকো থেকে চিলি। ইতালি থেকে স্পেন। ফ্রান্স থেকে ব্রিটেন। সৌদি আরব থেকে কুয়েত। ইরাক থেকে ইরান। ভারত থেকে বাংলাদেশ। করোনার ছায়া পড়েছে সব জায়গায়। মৃত্যু হানা দিয়েছে সব দেশে।
দুর্দান্ত প্রতাপশালী মার্কিন প্রেসিডেন্টের কথায়ও অসহায়ত্বের ছাপ। কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর চোখে জল! দিশেহারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশজুড়ে ‘জনতার কার্ফু’ জারি করেছেন। গণমাধ্যমজুড়ে প্রচার করা হচ্ছে শোকগাথা। গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ রাখলে মনে হচ্ছে, পৃথিবীজুড়ে বিস্তীর্ণ সমাধি! যার এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত হেঁটে বেড়াচ্ছেন সংবাদকর্মীরা। পাতাঝরার মতো ঝরে পড়ছে জীবন। সেই খসে পড়া পাতার কথাই লিখতে হচ্ছে। বলতে হচ্ছে। আর এদিক-ওদিক চোখ ঘোরাতেই করোনাভাইরাস অবরুদ্ধ করে দিচ্ছে তাদের দৃষ্টি।
Advertisement
পৃথিবীর অসুখের এই দিনে বেঁচে থাকার তীব্র আকুতি নিয়ে গৃহবন্দী কয়েকশ কোটি মানুষ। আর যারা মরছেন তারা জেনে যাচ্ছেন জীবন কত বড় ট্র্যাজেডি! যেখানে মৃত্যুর পর আত্মীয়দের সাস্ত্বনা দেয়ার লোকও পাওয়া যাচ্ছে না! মৃত্যুই এক, আদি এবং চূড়ান্ত।
করোনাভাইরাস ধর্ম-বর্ণ সব ভেদাভেদ ভুলিয়ে সব মানুষকে এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেল। ধর্মভীরু ক্রিশ্চিয়ানকেও বলা হচ্ছে; রোববার চার্চে যাওয়ার দরকার নেই। ঘরে বসে প্রার্থনা করো। ধর্মভীরু মুসলিমকে বলা হচ্ছে, ঘরে বসেই নামাজ আদায় করো। হিন্দুকে বলা হচ্ছে মন্দিরে জড়ো না হয়ে ঘরে বসেই প্রার্থনা সারো। প্যাগোডা নয়, সংক্রমণ এড়াতে বৌদ্ধদের পরার্মশ দেয়া হচ্ছে, প্রার্থনার জন্য নিজের ঘর অনেক পবিত্র জায়গা।
ধর্ম থাকছে ধর্মের জায়গায়। মানুষের বিশ্বাসের জায়গায়। কিন্তু কর্মক্ষেত্র, সেখানেও অবরুদ্ধ অবস্থা। জীবন-মৃত্যু সম্পর্কে সেখানেও দেয়া হচ্ছে ধারণা। জীবনের চেয়ে বড় নয় কাজ। পারলে বাসায় বসেই করো অফিসের কাজ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে সংবাদকর্মী ছুটে যান যুদ্ধের খবর কাভার করতে। যিনি আগুনের লেলিহান শিখার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে আগুনের ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়েন ‘বুম’ হাতে তাকে বলা হচ্ছে জীবনের চেয়ে খবর বড় নয়। আবার সেই সংবাদকর্মীই প্লেকার্ড উচিয়ে ধরে বলছেন, ‘আপনাকে সব খবর দিতে আমরা ছুটছি খবরের পেছনে। আপনি বাড়িতে থাকুন। নিরাপদ থাকুন। সাবধানে থাকুন।’
যে চিকিৎসক জীবনের ব্রত করেছেন অন্যের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবনের ২৪ ঘণ্টা কাটাচ্ছেন হাসপাতালে, তিনিও জানেন না কখন নিজেই আক্রান্ত করোনাভাইরাসে! পেশার প্রয়োজনে কত শবদেহ নাড়াচাড়া করতে হয় এদের, অথচ তারাও বাধ্য হয়ে চেম্বারের সামনে টানিয়ে দিচ্ছেন, খুব জরুরি না হলে ডাক্তারের কাছে আসার দরকার নেই। প্রয়োজনে ফোন করুন। সঙ্গে কতগুলো ডিজিট।
Advertisement
করোনা ছোবলে বন্ধ ক্রীড়া-বিনোদন। তালা ঝুলছে স্টেডিয়ামগুলোর গেটে গেটে। তারকা খেলোয়াড়রা ঘরবন্দী। যে যেভাবে পারেন সেভাবে চলে যাচ্ছেন কোয়ারেন্টাইনে। তারপরও নেট জেনারেশনের ক্রীড়াবিদরা টুইটার, ফেসবুক, ইউটিউবে আপলোড করছেন মানুষকে করোনা সচেতন করতে কত কিছু। জানাচ্ছেন কী চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন মেসি-রোনালদো-বিরাট-রুট-স্মিথ-মুশি-সাকিবরা।
সত্যি পৃথিবীর এই অসুখের সময় নিজেদের সুখের কথা ভুলে গেছেন বিভিন্ন পেশার আদ্যোপান্ত পেশাদার মানুষগুলো। এক পৃথিবীর বাসিন্দা এখন সবাই। সীমান্ত-কাঁটাতার-প্রাচীর-দেয়াল দিয়ে কত কিছু ভাগ করা হয়েছে। কিন্তু সবকিছুকে ভেঙেচুড়ে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য ভাইরাস। করোনা!
এখন সবার একটাই করণীয়। অসুখের পৃথিবীতে সুখ ফিরিয়ে আনা। সচেতনতা। সাবধানতা। সতর্কতায় মানুষই পারে পৃথিবীর সুখকে ফিরিয়ে দিতে। বিষণ্ন পৃথিবীতে বিপন্ন মানবতা। দরকার তাই সবার সচেতনতা।
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।
এইচআর/বিএ/পিআর