মো. ইমরান আহম্মেদ
Advertisement
করোনাভাইরাস! একবিংশ শতাব্দীতে এখন পর্যন্ত আবির্ভূত সবচেয়ে বড় হুমকি। যে রোগ সৃষ্টি করে নাম তার কোভিড-১৯। রোগ আছে, তবে ওষুধ নেই। তাই পরিস্থিতি আরও বেশি ভয়াবহ। এ পর্যন্ত ছড়িয়েছে ১৭০টির বেশি দেশে। প্রাণ হারিয়েছেন ১১ হাজারের বেশি মানুষ। আক্রান্ত তিন লাখের কম না। কি শক্তিশালী দেশ বা গরিব দেশ। করোনার সামনে সবারই এক হাল। ছুঁয়েছ তো, মরেছো। সংক্রমণ কমাতে এখন কেবল একটাই উপায়, যত পারো একা থাক। ভিড় এড়িয়ে চলো। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখো। তাতে যদি কিছুটা রক্ষা হয়।
এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। করোনা হতে পারে এই বিশ্বের জন্য অভিশাপ। কিন্তু এটি কারও কারও জন্য আশীর্বাদ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। বাজারে গেলেই তা বুঝতে পারবেন। কেবল শিবচর বাদে অন্য কোথাও শাট ডাউন করা হয়েছে- এমন খবর তো এখনো পাইনি। কিন্তু শিবচরকে এখন দাম বাড়ানোর এক অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
যে পণ্যের দাম একদিন আগেও ৫০ টাকা ছিল, কোনো কারণ ছাড়াই তা পরদিন সকালে বাড়ানো হচ্ছে। বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করবেন, খুবই গোছানো একটা উত্তর পাবেন। দাম বাড়তি, মাল কম। যদি খুচরা বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করেন, সে দেখাবে পাইকারি বিক্রেতাকে। আর যদি পাইকারি বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করেন, সে দেখাবে আড়তদারকে। আড়তদার দেখাবে আমদানিকারককে। এ যেন ভয়ংকর এক লোভী দুষ্ট চক্র।
Advertisement
করোনার কারণে অনেক কিছুর আমদানি-রপ্তানি বন্ধ। এতে ওইসব জিনিসের সরবরাহ কম থাকায় না হয় দাম বাড়তে পারে। কিন্তু দেশে উৎপাদিত মৌসুমি পণ্যের দাম দিনান্তে দ্বিগুণ হওয়ার উত্তর খুঁজতে গেলে কেবলই নিরাশ হতে হয়। অর্থনীতির এক সাধারণ সূত্র আছে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাজারে সরবরাহ বেশি হলে দাম কমে। কিন্তু আমাদের বাজার যেন ব্যতিক্রমে চলে। কখনো ইচ্ছা করেই বাজারে দ্রব্যের স্বল্পতার গুজব ছড়ায় একটি চক্র। এরপর দেখবেন, বাজারের বিক্রেতার কাছে আগে যে পরিমাণ পণ্য ছিল, এখনো সে পরিমাণই আছে। কিন্তু ক্রেতাকে বলবে দাম বাড়তি। সরবরাহ কম।
যেকোনো মোড়কজাত পণ্যের গায়ে লেখা থাকে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য এত টাকা। ওটা কিন্তু একজন ভোক্তার জন্য ওই পণ্য ক্রয়ের নির্ধারিত সর্বোচ্চ সীমা। কিন্তু ওই সর্বোচ্চ সীমাই আমাদের জন্য সবসময় নিম্ন সীমা। যদি কোনো কারণে দাম বাড়ার সুযোগটা পাওয়া যায়, তাহলে তো ঊর্ধ্বসীমার হয়ে যায় অসীম। তা না হলে ২০ টাকার মাস্কের দাম ২০০ টাকা হাঁকায় কীভাবে?
আমাদের মতো ঘনবসতির এই দেশে করোনার বিস্তার হলে মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে হবে। যেহেতু প্রতিষেধক নেই, এখন সচেতনাই একমাত্র অবলম্বন। এক্ষেত্রে সুরক্ষার জন্য মাস্ক, সাবান, হ্যান্ডওয়াশ, স্যানিটাইজার হতে অতীব প্রয়োজনীয় জিনিস। কিন্তু অবাক বিষয়, যেই না বাংলাদেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার খবর এলো, অমনি মাস্ক-স্যানিটাইজারের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেল। ব্যবসার জন্য মাস্ক আর স্যানিটাইজার হয়ে গেল মোক্ষম জিনিস। কিন্তু এমন দুর্যোগকালে এসব দাম হওয়ার কথা ছিল কম। কারণ, যদি বেশি দামের কারণে কেউ এসব জিনিস কিনতে না পেরে অরক্ষিত থেকে সংক্রমিত হন, তাহলে তিনি শুধু নিজের জন্যই নন, তিনি সবার জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হবেন।
আরেক দল তো ব্যবসার জন্য আরও জঘন্য উপায় বেছে নিল। টেলিভিশনের খবরে দেখলাম, হাসপাতাল থেকে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া মাস্ক শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে আবার ইস্ত্রি করে বিক্রি করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। কী করলে আমাদের মধ্যে বিবেক জাগ্রত হবে। ব্যবসার জন্য লোকজনকে কী ভয়ংকর বিপদে ফেলতে যাচ্ছি আমরা।!
Advertisement
অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ভোক্তা অধিকার দপ্তরসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে বাজার মনিটরিং করতে হচ্ছে। স্যানিটাইজারের দাম নির্ধারণ করে দিতে হচ্ছে সরকারকে। জেল-জরিমানা করে দাম কমাতে হচ্ছে। কিন্তু সামান্য বিবেকবোধ থাকলেও তো দেশের এই মুহূর্তে সবাইকে সবার পাশে দাঁড়ানো উচিত ছিল। দাম বাড়ানো তো দূরের কথা, উল্টো পারলে লাভ না করেই পণ্য বিক্রির দরকার ছিল। কারণ, করোনা আজীবন থাকবে না। হয়তো কয়েক মাসের বিষয়। এরপর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যদি কেউ করোনার কারণে মৃত্যুবরণ করেন- তাকে তো আর ফিরে পাবো না আমরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকারের নির্দেশনা মেনে আমাদের দেশেও মানুষের ঘরের বাইরে গমনাগমন কমছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে ইতিমধ্যে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। দৈনিক উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের আয় আরও কমেছে। এমন পরিস্থিতি অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু অবস্থা এমন যে এর বিকল্প নেই। এই দুঃসময় কাটিয়ে উঠতে হলে শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলেই হবে না। প্রতিটি নাগরিককেই দায়িত্ব নিতে হবে। নিজেকে যেমন সুরক্ষিত রাখতে হবে, তেমনি অপরকেও সুরক্ষিত করার হাত বাড়াতেই হবে। এটাই এখন সময়ের দাবি।
মানুষ যা কিছু করে তা জীবনের জন্য। কিন্তু জীবন-ই যদি না থাকে, তাহলে সম্পদ দিয়ে আর কি হয়। করোনা আজ অনেক কিছুর জন্য হুমকি। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো জীবনের জন্য হুমকি। কারণ, করোনা কোনো ধর্ম মানে না। করোনা কোনো বর্ণ মানে না। গরিব বুঝে না, ধনীও চেনে না। তার দরকার বংশ বৃদ্ধি করার মতো একটা পরিবেশ। কণ্ঠনালী কিংবা ফুসফুস।
দেশের এই সময় একবারের জন্য হলেও সবাইকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে আমাদের। নির্লজ্জের মতো করোনাকে ব্যবসার মোক্ষম হাতিয়ার বানিয়ে মানুষের পকেট কাটার অপচেষ্টা বন্ধ করি। ক্রেতা বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে আরও লাভ করতে পারবেন। কিন্তু মরে গেলে চিরদিনের জন্য এক ক্রেতাকে হারাবেন। কারসাজি করে দাম বাড়ানোর আগে বিষয়টি অত্যন্ত একটিবার ভাবুন, প্লিজ!
লেখক : সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস), বাংলাদেশ পুলিশ, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা।
এইচআর/এমকেএইচ