স্বাধীনতা দিবসের একটা অনুষ্ঠান করার কথা ছিল আমাদের। হল বুকিং দেয়া, শিল্পীদের বলে রাখা হয়েছে। নিজস্ব সংগঠনের সবাই রিহার্সেল করছে। কিন্তু সহসা আমাদের অনুষ্ঠান স্থগিতের ঘোষণাটা দিতেই হয়। ব্রিটিশ সরকার ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে বার-পাব-রেস্টুরেন্টে মানুষ যেন না যায়। জনহীন হয়ে পড়ছে ক্রমেই ব্রিটেনের জনপদ। পিকাডেলি সার্কাস, ট্রাফালগার স্কয়ারের মতো জনবহুল এলাকা এখন নীরব, অথচ এই এলাকাগুলো ঘুমায় না কখনও। বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হোয়াইট চ্যাপল কিংবা ব্রিকেলেন যেন শান্ত, নেই কোলাহল।
Advertisement
আমার আবাস যে শহরে, সেই শহর (ম্যানচেস্টার) রাতে এমনিতেই খুব একটা জীবন্ত নয়। শুধু শুক্রবার-শনিবার রাতটা কোলাহলময় হয়ে ওঠে শহরটি। দিনে থাকে গাড়ির ভো ভো আওয়াজ। এখন যেন বন্ধ হয়ে গেছে সেই আওয়াজ। সুনসান নীরবতা নেই যদিও। সন্ধ্যার সাথে সাথে শহরটির উপকণ্ঠে নামে ভূতুড়ে নীরবতা। এখন ম্যানচেস্টারে রাত শেষে প্রভাত হয় যেন পিপীলিকার মতো মানুষের খাদ্য অন্বেষণের জন্য। সকাল হওয়ার সাথে সাথে মানুষ সুপার স্টোরেগুলোতেই দৌড়ায়। স্টোরগুলোতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ আনা হয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা আছে, দ্রব্যে ঘাটতি থাকবে না অন্তত দেশের সংকটময় আগামী সময়েও। তবুও কে শোনে কার কথা। করোনাভাইরাসের আতঙ্কের চেয়ে সংকটকালীন আয়েশী খাবারের আয়োজনে এরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এখন পর্যন্ত দেখা গেছে, করোনা আতঙ্ক শুরু হওয়ার পর থেকে শুধু মার্চ মাসেই ৫৭.৩ মিলিয়ন পাউন্ডের অতিরিক্ত শপিং করেছে ব্রিটেনের আতঙ্কিত নাগরিক। বিস্ময়কর সত্য হলো, টয়লেট টিস্যু নিয়ে মানুষের কাড়াকাড়ি এমনকি হাতাহাতির ঘটনা। কারণ পশ্চিমা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ যতটুকু নিজেদের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কথা বলে তার চেয়ে অনেক অল্পই চর্চা করে। এই সংকটে তা-ই প্রমাণিত হয়েছে। তারা পানির ব্যবহার শুধু হাত ধৌত করার কাজেই করতে চায় হয়তো।
পাকিস্তানি-বাংলাদেশি অধ্যুষিত গ্রোসারি দোকানগুলোতে (ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি) এশিয়ান মানুষের ভিড়। সেখানে গেলেই মনে হয়, যেন তারা তাদের সারাজনমের খাবার কিনে নিতে চান। আমার বাস করা শহরের পাশে মূলত পাকিস্তানি গ্রোসারিগুলোই অধিক। প্রতিদিন সেখানে শত শত মানুষ ভিড় করছে, এদের একটা বিশাল অংশ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। সবাই কেনাকাটা করছে দেদারসে। যেন উৎসবে মেতে উঠেছে তারা। ঈদের আগে যেভাবে শপিং করে মানুষ, সেই কেনাকাটাই তারা করছে।
Advertisement
লন্ডনের একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এতে দেখা গেছে, একজন মানুষ তার ট্রলিতে ২০ কেজি ওজনের যত বস্তা চাল জায়গা করা যায়, ততটাই ভরছে। মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে, বে-আক্কেলের মতো সে হাসছে, অথচ সে সময় মানুষ ওই দোকানে চালের তাকটা প্রায় শূন্য হতে চলছে। চাল পাচ্ছে না। আমি আমার সামান্য বাজারের জন্য গেছি সেদিন, তিনটা চিকেন কিনেছি। দেখলাম এর আগের সপ্তাহে যেগুলোর দাম ছিল ৯ পাউন্ড, তা ১১ পাউন্ড দিয়ে কিনে আনলাম, দুই মাস আগে যে চাল নিয়েছিলাম ১৯ পউন্ড দিয়ে, তার দাম পড়ল ২৩ পাউন্ড।
আমার কাছে মনে হলো, বাজার খুব একটা নিয়ন্ত্রণ হারায়নি। কিন্তু বিকেলে আমার এক আত্মীয়া অন্য দোকানে গিয়ে একটা মাত্র চিকেন নিয়ে আসলেন, এ দোকানটাও পাকিস্তানিই। অথচ একটা চিকেনের দাম দিয়েছেন তিনি ১০ পাউন্ড। এক পরিচিত রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ২৩ পাউন্ড ৯৯ পেন্সের চাল তিনি কিনেছেন আরেক বাংলাদেশি দোকানদারের কাছ থেকে ৪০ পাউন্ডে। চড়া মূল্যে দ্রব্য বিক্রির জন্য ওল্ডহ্যাম শহরের একটা গ্রোসারি শপে গিয়ে বাঙালি তরুণরা হেনস্থা করেছে আরেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীকে এবং এখন এদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন লোকজন।
অন্যদিকে দ্রব্যের অধিক মূল্যের প্রমাণ থাকলে আইনি পদক্ষেপে একটা দোকান বন্ধও করে দিতে পারে ট্রেডিং স্ট্যান্ডার্ড কাউন্সিল। মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা আতঙ্ক সৃষ্টি করে জনগণকে নগদমূল্য দিয়ে দ্রব্য কিনতে এক ধরনের চাপে ফেলছে। এই অসাধু ব্যবসায়ীদের দাপটের মাঝেও বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকার কিছু কিছু সুপারস্টোর আছে, যেগুলোর মালিক বাংলাদেশি, তারাও অনেকটা নাগালের ভেতরেই রাখছেন তাদের দ্রব্যমূল্য। বিশেষত ছোট ও মাঝারি মানের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়েছে, কারণ এদের জবাবদিহিতা নেই। এরা কার্ড নিচ্ছে না, শুধু নগদ পাউন্ডে ব্যবসা করছে। কারণ কার্ডের ব্যবসা প্রমাণসাপেক্ষ।
হাইস্ট্রিট সুপারস্টোরগুলো যেমন আসদা, টেসকো এগুলোতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়নি। এমনকি হালাল মাংস পর্যন্ত তারা বিক্রি করছে আগের দামেই। ক্রেতাদের ভিড় উপচে পড়ছে। পলিসিগত পরিবর্তন এনেছে তারা। অত্যধিক চাহিদার জিনিসের ওপর নিয়ন্ত্রণ বসিয়েছে, ‘একটা অথবা এক প্যাকেটের বেশি কেনা যাবে না’ এভাবে তারা আতঙ্ক কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে, ওই জায়গায় বাঙালি-পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ মানুষকে আতঙ্কের দিকেই ঠেলে দিয়ে ব্যবসা লুফে নিচ্ছে। কিছু ইতরশ্রেণির অসাধু বাংলাদেশি-পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা চেষ্টা চালাচ্ছে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করার। সব মিলিয়ে ব্রিটেনের চারপাশের আতঙ্কটা চাপা নয়। এ এক বিস্তৃত আতঙ্ক। রোগ নিয়ে আতঙ্কের চেয়ে ঘরে বসে খাবারের সংগ্রহটাই হয়ে গেছে তাদের কাছে প্রধান।
Advertisement
সে হিসেবে সবাইকে যার যার বাসায় অবস্থান নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হয়তো বা। স্কুল বন্ধের রাষ্ট্রীয় ঘোষণা এসেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ভাইরাস শিশু-কিশোরদের খুব একটা কাবু করতে পারছে না। এ কথাটা সত্যিও। এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসে কোনো অল্পবয়স্ক মারা যায়নি। যদিও প্রশ্নটা অবান্তর, তবুও বলতেই হয় এ ভাইরাস শুধুই কি বয়স্কনিধনের কোনো বোম্বসেল, এ ভাইরাস কি পুরোনোদের দিকেই আগায়?
এখানে একটা কথা উল্লেখ করা যায়, ব্রিটেনে প্রতিবছর অন্তত ১০ হাজার মানুষ মারা যায় সাধারণ ফ্লু ভাইরাসে এবং এ মৃত্যুও মূলত বয়স্ক এবং হাইরিস্ক রোগী যেমন অ্যাজমা, হাইব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিক, ক্যানসারসহ যারা বিভিন্ন রোগে ভুগছেন তাদেরই আঘাত করছে। সে হিসাবে বয়স্কদের জন্য ব্রিটেনের স্পষ্ট ঘোষণা অন্তত তিন মাস যেন ঘরে বসে থাকেন। এ বয়স্কদের একটা বড় অংশ সরকারই দেখাশোনা করে, না হয় তাদের নিজেদের পেনশন নিয়ে দিন চালাচ্ছেন। সুতরাং তাদের ঘরে অবস্থানকালীন অর্থনৈতিক সমস্যা না থাকলেও এদের একাকীত্বই হতাশার দিকে ঠেলে দেবে, এটাও একটা শঙ্কা।
৭৩ বছরের একজন শেতাঙ্গ মানুষ সেদিন বললেন, তিন মাস বের হতে না পারলে আমিতো এমনিতেই মারা পড়ব। কারণ ওই মানুষগুলোর সামাজিক যোগাযোগের জায়গাটাই পাব কিংবা বার কিংবা সোশ্যাল ক্লাব। এগুলো প্রায় বন্ধ শুক্রবার থেকে। দেশব্যাপী স্বেচ্ছাসেবীরা বয়স্কদের পাশে থাকার বিভিন্ন স্কিম হাতে নিয়েছে যদিও, কিন্তু এ এক নিদারুণ হতাশা থেকে মুক্ত রাখা রাষ্ট্রের পক্ষে কতটুকুই সম্ভব। কারণ এই বয়স্ক মানুষদের অধিকাংশই একা, সঙ্গী কিংবা সঙ্গীনিহীন।
শুক্রবার পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৭৭ জন মানুষ। গণমাধ্যম বলছে, ব্রিটেনের করোনা সংক্রমণের পর এত লোকের মৃত্যুতে তারা শঙ্কিত। মৃত্যুর মিছিলে যোগ হতে পারে আরও অসংখ্য মানুষ। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন প্রতিদিনই নতুন নতুন সংগ্রামের কথা বলছেন। আশায় বুক বাঁধাচ্ছেন ব্রিটেনের মানুষকে। জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা (এনএইচএস) থেকে অবসরে যাওয়া অন্তত ৬৫ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীকে দেশের এই সংকট সময়ে আবারও সাময়িক সহযোগিতার আহ্বান করেছে সরকার। এ আহ্বান কেউই উপেক্ষা করেনি।
সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতার হিসেবে নতুন নতুন প্রণোদনার ঘোষণা এসেছে। চাকরি খোয়ানো মানুষদের অর্থনৈতিক লস পুষিয়ে দেয়ার ঘোষণাও আছে। বাড়িভাড়া পান অনেকেই সরকারের অনুদান থেকে, এ রকম অনুদান থেকে স্বল্প আয়ের মানুষও বাড়িভাড়ার একটা অংশ পান। এখন বাড়ির মালিকদেরও এই অসময়ে কাছে থাকতে গিয়ে মর্টগেজ নিয়ে নতুন পথ দেখিয়ে দিয়েছে সরকার। লোনগ্রহণকারীদের ইন্টারেস্ট রেট কমিয়ে ০.৯ শতাংশে নিয়ে আসা হয়েছে, যা ব্রিটেনের ইতিহাসে খুব একটা দেখা যায় না। মসজিদ-মন্দির-গির্জাসহ উপাসানলয় বন্ধ হয়ে গেছে অনেক জায়গায়। লোকসমাগমে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়েছে। খেলা-কনসার্ট স্থগিত করা হয়েছে।
বিশ্বগ্রাসী অর্থনৈতিক মন্দা হাতছানি দিচ্ছে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী আশা দিচ্ছেন, তিন মাসের মধ্যেই ব্রিটেন আবার ঘুরে দাঁড়াবে। শুধু যেন নির্দেশনা মানে নাগরিক। এই ক্রান্তি সময়ে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে একটা মাত্র ভয়েসই হতে হবে, এই ব্রিটেন, এই জনগোষ্ঠী এই সমাজকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আর সে জন্য নির্দেশনা না মানার কোনো যুক্তি নেই। ভাবতে হবে সবাইকে। একজন প্রধানমন্ত্রীই শুধু এই দেশের নির্ভরতার জায়গা নয়। তাইতো যেমন সরকারের সবাই একবাক্যে বরিস জনসনের পক্ষেই বলছে না, সমালোচনার জায়গাটাতে হাত দিচ্ছে তার নিজের দলের লোকও, মিডিয়া আলোচনা আছেই। আবার অন্যদিকে বিরোধী দল সরকারের সব পজিটিভ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছে পার্লামেন্টেই। পাশে থাকার অঙ্গীকার করছে তারা। কারণ রাজনীতি জাতির জন্য, জনগণের জন্য, সংকটকালে ঐক্যবদ্ধভাবে জয় করার নামই জনগণের রাজনীতি।
এইচআর/বিএ/এমএস