চীনের উহানে করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে। ২৩ জানুয়ারি করোনাভাইরাস ঠেকাতে উহান শহরকে পুরো চীন থেকে বিচ্ছিন্ন (লকডাউন) করে দেয়া হয়। তখন থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে, নতুন এ ভাইরাসের সংক্রমণ চীনের বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
Advertisement
সংক্রামক করোনাভাইরাস সামলাতে প্রস্তুতির জন্য প্রায় দেড় মাস সময় পেয়েছে বাংলাদেশ, যা অনেক দেশই পায়নি। কিন্তু দেশে করোনায় আক্রান্ত এক ব্যক্তির মৃত্যুর পর যখন প্রতিদিনই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, তখন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, শুরুর দিকে তাদের প্রস্তুতিতে ‘ব্যর্থতা’ ছিল। তাই এখন সেই ‘ভুল’ শোধরাতে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় করে করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে চান তারা।
বৃহস্পতিবার (১৯ মার্চ) দুপুরে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও মোকাবেলা-সংক্রান্ত বিভাগীয় কমিটির সভায় অংশ নিয়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার এ বি এম আজাদ, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) হাসান শাহরিয়ার কবির, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার মো. গোলাম ফারুকসহ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এমন বক্তব্য তুলে ধরেন।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার এ বি এম আজাদ বলেন, ‘কিছু ব্যর্থতা আছে, করোনা নিয়ে শুরুর দিকে প্রবাসীদের নিয়ন্ত্রণে আমাদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি ছিল। ইতোমধ্যে তারা তাদের পরিবার ও সমাজের সঙ্গে মিশে গেছে, এক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা দেরি হয়ে গেছে, কিছু ভুল ছিল। মিস-ম্যানেজমেন্ট যেহেতু হয়ে গেছে, তাই এখন থেকে আমাদের তাদের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করে ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা (প্রবাসীরা) যেন হোম কোয়ারেন্টইন মেনে চলেন, তা শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।’
Advertisement
করোনা ঠেকাতে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার মো. গোলাম ফারুক বলেন, ‘আমরা এখন কেন বলছি, কারা কোথায় মিশে গেছে, আমরা ১০ দিন পরে এসে কেন এসব বলছি? প্রথম দিকে বিমানবন্দরে কী হয়েছে? অনেক ক্ষেত্রে শুধু জ্বর মেপেই তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। শুরুর দিকে দেখা গেছে, বিমানবন্দরে বলা হতো আপনারা কারা চীন থেকে আসছেন লাইনে দাঁড়ান। দেখা গেছে ৪৫ জন চীন থেকে এলেও পাঁচজন লাইনে দাঁড়িয়েছেন, আর ৪০ জন অন্য লাইনে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেছেন। অনেকে ইতালি থেকে এসে পরিবার নিয়ে সাজেক আর কক্সবাজারে বেড়াতে গেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রবাসীদের হোম কোয়ারেন্টাইন বাস্তবায়নে কোনো দয়া দেখানো যাবে না। এক্ষেত্রে আমরা প্রতিবেশীদের কাজে লাগাতে পারি। প্রবাসফেরতদের আশপাশের মানুষদের মোবাইল নম্বর জোগাড় করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। জানতে হবে প্রবাসী ব্যক্তি হোম কোয়ারেন্টাইন ভালোভাবে পালন করছেন কিনা। এক্ষেত্রে শহরে ঝুঁকি বেশি, কারণ শহরে যারা এসেছেন তাদের ট্রেস করা যাচ্ছে না।’
ফেনী জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘বিমানবন্দর ও গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে প্রবাসীদের যে তালিকা দেয়া হচ্ছে তা পূর্ণাঙ্গ নয়। কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে ব্যক্তির নাম উল্লেখ আছে আব্দুল জাব্বার, ঠিকানা সোনাগাজী। এখন এত বড় উপজেলায় আমরা কীভাবে বের করবো যে কোন আব্দুল জাব্বার দেশে এসেছেন? এক্ষেত্রে যদি কোনো প্রবাসী দেশে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তার পূর্ণাঙ্গ ডাটা সংগ্রহ করা হতো, তাহলে তার হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা যেত।’
এসব বিষয়ে আরও অনেক আগে থেকেই সমন্বয় করা প্রয়োজন ছিল বলে মত দেন তিনি।
Advertisement
জবাবে বিভাগীয় কমিশনার এ বি এম আজাদ বলেন, ‘আগে যা হয়েছে হয়েছে, এখন সেটা রিকভার করতে হবে। এখানে ইমিগ্রেশনের যারা আছেন, তাদের বলবো প্রবাসফেরতদের পাসপোর্টর একটি কপি আপনারা সংরক্ষণ করবেন। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ইমিগ্রেশন থেকে তথ্য নিয়ে এখনই প্রবাসফেরতদের আইডেন্টিফাই করবেন।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বৃহস্পতিবার করোনা সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে জানান, দেশে নতুন করে আরও তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এরা ইতালিফেরত করোনা আক্রান্তের সংস্পর্শে থাকায় আক্রান্ত হয়েছেন। সবমিলিয়ে দেশে এখন করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১৭ জনে দাঁড়ালো। আইসোলেশনে রয়েছেন ১৯ জন, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে ৪৩ জন। সুস্থ হয়েছেন তিনজন।
সভায় অংশ নিয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনাপ্রাপ্ত প্রবাসীদের চিহ্নিত করতে তাদের হাতে অমোছনীয় কালির সিল দেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ থেকে এমন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে এমন কালি ব্যবহার করা হবে যা ১৫ দিনেও মুছে যাবে না কোনোভাবেই।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার আমেনা বেগম বলেন, ‘স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয়া হলেও শিক্ষার্থীরা লুকিয়ে কোচিং সেন্টারে যাচ্ছে। আমাদের পরামর্শ থাকবে, শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের জন্য আগামী এক মাসের পড়ার সিলেবাস তৈরি করে অভিভাবকদের দেয়া। এছাড়া ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে জমায়েত হতে না দেয়া। মালয়েশিয়ায় তাবলিগ জামাতের ১০ হাজার মানুষের একটি সমাবেশ থেকে সেখানে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। এখন পুরো মালয়েশিয়া লকডাউন করে দেয়া হয়েছে। অথচ সিঙ্গাপুর নিজেদের লকডাউন করেনি। তারা সব সতর্কতা মেনে বন্দরগুলো চালু রেখেছে।’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে সাধারণ রোগীদের জন্য উন্মুক্ত রেখে আলাদা কোথাও করোনা রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে মত দেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবির।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক এ কে এম সামসুল হক খান বলেন, ‘গত ১ মাসে কুমিল্লার প্রায় ১০ হাজার প্রবাসী দেশে ফিরেছেন। কিন্তু ১০ শতাংশ প্রবাসীও জেলায় নেই। এদের বেশিরভাগই ঢাকায় থাকেন। এ কারণে সেখানে আক্রান্ত হয়ে রোগ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।’
চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মো. মাজেদুর রহমান খান বলেন, ‘গত একমাসে চাঁদপুরের ৫ হাজার ৪৪৯ জন প্রবাসী দেশে ফিরেছেন। এদের মধ্যে ভারত থেকে ফিরেছেন ৯৫২ জন। বাকিরা আরব আমিরাত, সৌদি আরব, বাহরাইন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালি থেকে এসেছেন। যাদের অনেকে ঢাকায় থাকছেন। তবে আমরা তাদের বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করছি। বিদেশফেরত চাঁদপুরের ৬০৪ জনকে ‘হোম কোয়ারেন্টাইনে’ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন। গত ১২ তারিখ থেকে আমরা কাজ শুরু করেছি। কোয়ারেন্টাইন বাস্তবায়নে পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মী ও গ্রাম পুলিশকে কাজে লাগাচ্ছি।’
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘করোনা সামলাতে স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, কিন্তু আমরা দেখছি স্কুল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীদের পিকনিকে নিয়ে আসা হচ্ছে! এছাড়া কক্সবাজারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রোহিঙ্গা ক্যাম্প। এখানে যদি একবার ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে এখানে একটি মেডিক্যাল সেন্টার স্থাপনের বিষয়ে ভাবা হচ্ছে।’
এসময় বিভাগীয় কমিশনার এ বি এম আজাদ বলেন, ‘বিভাগের সবগুলো পর্যটন কেন্দ্র ইতোমধ্যে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কক্সবাজারে যদি কেউ যায়, তাহলে তাদের এন্ট্রি পয়েন্টেই আটকাতে হবে, কোনোভাবে শহরে প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না।
এসময় তিনি জনগণকে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। করোনা পরিস্থিতি সামলাতে অতি দ্রুত বিভাগীয় কমিটি কাজ শুরু করবে বলেও জানান এ বি এম আজাদ।
আবু আজাদ/এইচএ/পিআর