লন্ডন থেকে ফিরেছেন সম্প্রতি। তাই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়টা ছিলোই। তার ওপর কলকাতায় একজন করোনা আক্রান্ত পাওয়া গেছে। সে কারণে ভয়টা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। দেশে ফিরেই তড়িঘড়ি করে কোয়ারেন্টাইনে গেছেন টালিউডের অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী।
Advertisement
নিজ গৃহে গৃহবন্ধী তিনি। সেখানেই দুদিন ধরে কাটছে তার সময়। কারো সঙ্গে মিশছেন না। কথা সারছেন দূর থেকে। সময় কাটানোর জন্য বেছে নিয়েছেন নেটফ্লিক্স। সেই সঙ্গে লেখালেখি শুরু করেছেন। মিমি লিখতে শুরু করেছেন করোনা নিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা। সেখানে তিনি তুলে ধরেন করোনার সঙ্গে তার লড়াইয়ের গল্পটা।
আনন্দবাজারের বরাতে সেই লেখা তুলে ধরা হলো-
১২ মার্চ, বৃহস্পতিবার, কলকাতা, বিকেল ৪টাআজ সকাল থেকে ফোন আর এসএমএস। সবার এক কথা ‘এখন শুট করতে লন্ডন যাওয়া ঠিক নয়।’ কাছের বন্ধুরা তো রীতিমতো চিৎকার করছে।
Advertisement
১২ মার্চ, বৃহস্পতিবার, কলকাতা, সন্ধ্যা ৬টামেকআপ ম্যান বুম ফোন করল। ও দেখলাম প্যারানয়েড। কিন্তু আমি কীভাবে বলি শুটিং ক্যানসেল? অসম্ভব! আমার পুরো শুটিং টিম আগেই পৌঁছে গেছে। ওরা লন্ডনে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে তো যেতেই হবে।
১৩ মার্চ, শুক্রবার, কলকাতা বিমানবন্দর, রাত ২টাএমিরেটসের ফ্লাইট। একটু আগেই চলে এলাম। মাস্ক পরে পৌঁছলাম বিমানবন্দর। দেখলাম কলকাতা বিমানবন্দর স্বাভাবিক। আমি ঠিক করেছি আমাকে সতর্ক থাকতে হবে। আমি অবশ্য হাইজিন নিয়ে বরাবর খুঁতখুঁতে। এবার তো সতর্কতা আরও অনেক বেশি।
১৩ মার্চ, শুক্রবার, কলকাতা বিমানবন্দর, ভোর ৫টাফ্লাইটে উঠেই আমার সিট, কম্বল, আইপ্যাড, বিছানা আর সামনের স্ক্রিন— সব স্যানিটাইজার দিয়ে মুছেছি। ওয়াশরুমে কলের নব, বাথরুম সিট সব স্যানিটাইজার দিয়ে যতবার গিয়েছি ক্লিন করেছি। এমনকি বিমানবন্দরের টয়লেটেও হ্যান্ড শাওয়ার, নব সব স্যানিটাইজার দিয়ে ক্লিন করেছি। ফ্লাইটের দরজা বন্ধ হলো। মনে মনে জগন্নাথ দেব’কে স্মরণ করে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিলাম।
১৩ মার্চ, শুক্রবার, দুবাই বিমানবন্দর, সকাল ১০টাএ কী! এতবার এসেছি এখানে, আগে কখনও এত ফাঁকা দেখিনি। করোনার আঁচটা এখানে এসে সবচেয়ে বেশি টের পেলাম। স্কেয়ারি লাগছিল। ঝলমলে দুবাই বিমানবন্দরকে অমন ব্ল্যাঙ্ক দেখে। প্রত্যেকটা শাটার নামানো। ওয়েটিং এরিয়ায়ও কেউ নেই। শুধু আমরা ফ্লাইট থেকে কয়েক জন মানুষ নামলাম! এবার একটু যেন ভয় ভয় লাগছে।
Advertisement
১৩ মার্চ, শুক্রবার, হি থ্রো বিমানবন্দর, বিকেল ৫টামাস্ক পরে নামলাম বিমানবন্দরে। ফোন খুলে দেখলাম 'টেক কেয়ার' আর 'কেন যাচ্ছ' কমেন্টে ভর্তি ফোন। হিথ্রো বিমানবন্দর নেমে ভালো লাগছে। মোটের ওপর স্বাভাবিক। নিজের ছন্দেই যেন চলছে। দিব্যি মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুবাইয়ের থেকে একেবারেই আলাদা। কে বলবে এ দেশে করোনার মতো প্রাণঘাতী রোগ থাবা বসিয়েছে?
১৪ মার্চ, শনিবার, লন্ডন সকাল ৮টাশিডিউল অনুযায়ী শুটও চলছে। আজ আমার শুট নেই। ভাবলাম একটু ঘুরেই আসি। রাস্তায় হাঁটতে কার না ভালো লাগে? তাও আবার লন্ডনের রাস্তায়? ঠান্ডাও জমিয়ে আছে। বেশ লাগছিল হাঁটতে। অক্সফোর্ড স্ট্রিটে পৌঁছলাম। স্যানিটাইজার আমার সঙ্গী। মাস্কও পরেছি। কিন্তু রাস্তায় দেখি কেউ মাস্ক পরছে না। এ কী? কিছুই যেন হয়নি এমন চালে লোকজন হাঁটাচলা করছে। বাচ্চা, কম বয়সী, বয়স্ক...শনিবার বলে সব্বাই ছুটির মেজাজে। আমি তো অবাক!
১৪ মার্চ, শনিবার, লন্ডন, রাত ৯টাদেশ থেকে শুধু ফোনে, হোয়াটস্অ্যাপে আতঙ্কের আঁচ। পরদিন শুট। রাতে ঠান্ডা বাড়ল। শুয়ে পড়ছি এখন।
১৫ মার্চ, রোববার, লন্ডন দুপুর ২টাআমার শুট শুরু হলো সকাল থেকে। ওখানেও ইউনিটের সবাই দেখলাম স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুচ্ছে। হাইজিনের ওপর নজর রাখছে। তবে শুটে আমি, জিৎদা, বিশ্বনাথ কেউ মাস্ক পরিনি। মেকআপ করে তো আর মাস্ক পরা যায় না। এ দেশে কেউ তো মাস্ক পরছে না। দেশে ফিরে মাস্কের বিষয়টা নিয়ে আর একটু ক্লিয়ার করতে হবে।
১৫ মার্চ, রোববার, লন্ডন রাত ১০টাশুট চলছে...বিকেলের দিকে সে দিন প্রথম লোকাল কোঅর্ডিনেটরের কাছে শুনলাম, করোনা খুব তাড়াতাড়ি ছড়াচ্ছে বলে স্কুল, কলেজ এ বার হয়তো লন্ডনে বন্ধ হবে। এই প্রথম করোনার কথা কানে এল।আর অক্সফোর্ড স্ট্রিটেই শুট হচ্ছে আমাদের। এ ভাবেই কাটল আর একটা দিন।ঠান্ডা বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে।দেখা যাক কাল কী হয়!
১৬ মার্চ, সোমবার, অক্সফোর্ড স্ট্রিট, লন্ডন, রাত ৯টাসকাল থেকে আজও আমরা শুটে। আজ কোঅর্ডিনেটরের গলা অন্য রকম। শোনা গেল করোনা তাড়াতাড়ি ছড়াচ্ছে। আর দেশ থেকেও ফোন আসা বাড়তে লাগল। সক্কলে প্যানিক করছে। টেক্সট আসছে ‘কামব্যাক মিমি’। বুঝতে পারছি না কী হবে। শুটের ছবিও পোস্ট করলামএটা বোঝাতে, আমরা ভাল আছি, কাজ করছি। কিন্তু সব মিলিয়ে বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা হয়তো হবে। শুট চলছিল...সন্ধেবেলায় খবর এল আমাদের শুট বন্ধ করে পরের দিন ভোরের ফ্লাইটেই ফিরতে হবে। জরুরি অবস্থা। আর নয়। সরকার থেকে বলেছে ১৮ মার্চের মধ্যেই দেশে ফিরতে হবে।কোনওমতে জিনিস গুছিয়ে নিলাম। রাতেই মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হল। মা কে বললাম সবাই এত ফোন করছে, টেনশন করছে তুমি একবার ফোন করবে তো? তোমার টেনশন হচ্ছে না? ফোনের ওপারে মায়ের গলা স্বাভাবিক। মা বলল, ‘তুই সকলের সঙ্গে কাজে গিয়েছিস। সকলের সঙ্গেই তো আছিস। সকলের যা হবে তোরও তাই হবে।’ আমি জানি মা এ রকম কিছুই বলবে। ছোট থেকেই আমার কাজ, আমার সিদ্ধান্তের ওপর মায়ের অগাধ আস্থা। মা জানে, আমি এতটাই শক্তসমর্থ, যে কোনও পরিস্থিতিতেই আমি ঠিক ফাইট করে বেরিয়ে আসব।
১৭ মার্চ, মঙ্গলবার, লন্ডন, ভোর ৫টাখুব ভোরের ফ্লাইট। আমরা ফিরছি। কিন্তু লন্ডনে তখনও শাটডাউন, লকডাউন কিছুই দেখছি না। কী যে হচ্ছে! ভোরবেলার চেনা হিথরো দেখলাম খানিক বদলেছে। একটু ফাঁকা ফাঁকা যেন।
১৮ মার্চ, বুধবার, কলকাতা, সন্ধে ৬টাকলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছলাম ৭টা নাগাদ। এ বার আসল পরীক্ষা। এর মাঝেও আমি আর জিৎদা স্যানিটাইজার ব্যবহার করা থেকে গ্লাভস চেঞ্জ করা সব করেছি। বিমানবন্দর বেশ ফাঁকা। আমার মেডিক্যাল স্ক্রিনিং শুরু হল। এই প্রথম কেমন দু’সেকেন্ডের জন্য ভয় করে উঠল। স্ক্রিনিং মনিটরের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে জম্বি মনে হচ্ছিল। পা থেকে মাথা স্ক্রিন করা হল। লাল, সবুজ রং হয়ে আসছিল কী সব। মাথায় কী একটা ঠেকাল। তারপর পরীক্ষায় পাশ করলাম। উফফফ! ওই সময়টা একটু কেমন লেগেছিল। টিমের সকলের ওই পদ্ধতিতে স্ক্রিনিং হওয়ার পর বাড়ি এলাম। এখন বাড়িতে। সেই কনকনে ঠান্ডা নেই। বেশ ফুরফুরে সন্ধে। এখন কোনও তাড়া নেই। কাজ নেই। দেখতে পাচ্ছি, আমার পঁয়ষট্টি বছরের বাবা আমার থেকে অনেক দূরে বাড়ির আর এক প্রান্তে বসে।আমি লন্ডনে যাওয়ায় আমার বাড়ির দুটো বাচ্চা, অফিস, লোকজন দেখাশোনা করার জন্য মেয়ের বাড়িতে এসেছিল বাবা। মা জলপাইগুড়িতে। এত দিন পর মেয়েকে ফিরতে দেখে বাবা আমার কাছেই চলে আসছিল। আমি কোনওমতে ঠেকাই।
আমার ঘরে এখন বন্দি আমি। বাচ্চা দুটোকেও কাছে আসতে দিচ্ছি না। ওরা আমার প্রাণ। ডিসপোজেবল প্লেটে খাবার খাচ্ছি। আমার হাউজস্টাফরা কেউ কাছে আসছে না। বাইরের কোনও লোকও না। কিচেনে অবধি যাইনি। এ ভাবে চোদ্দো দিন নিজের হয়ে থাকব। থাকতে আমাকে হবেই। যদি আমার কিছু হয়েও থাকে সেটা মিমি চক্রবর্তী অবধি থাক... এটাও একটা লড়াই।
এলএ/জেআইএম