ধর্ম

মহামারিতে প্রথম শহিদ হয়েছিলেন বিশ্বনবির যে সাহাবি

৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু মহামারি প্লেগের কারণে সিরিয়ায় তার রাষ্ট্রীয় সফর স্থগিত করে মদিনায় ফিরে গিয়েছিলেন। সময়ের আলোকে তা ছিল তার সুন্নাতের যথাযথ অনুসরণ ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। সে সময় মহামারি প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শহিদ গিয়েছিলেন জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত সাহাবি সেনাপতি হজরত আবু উবায়দাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু। হজরত ওমরের নির্দেশেও তিনি মহামারি আক্রান্ত অঞ্চল ত্যাগ করেননি। করোনাসহ মহামারি সতর্কতায় এটিও একটি শিক্ষণীয় ঘটনা।

Advertisement

হজরত ওমরা রাদিয়াল্লাহু আনহু সিরিয়া সফরের উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে বের হয়ে ‘সারগ’ নামক অঞ্চলে পৌছলে সেনাপতি আবু উবায়দাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে সিরিয়ায় মহামারি প্লেগে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানান। ইসলামে ইতিহাস এ ঘটনা তাউন আম্মাউস (طاعون عمواس) নামে পরিচিত। সে সময় তিনি সফর স্থগিত করে মদিনায় ফিরলেও সেনাপতি আবু উবায়দাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু মহামারি আক্রান্ত অঞ্চল ছেড়ে মদিনায় ফিরে যাননি। পরিণতিতে তিনি মহামারি আক্রান্ত হয়ে শহিদ হন।

হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু মদিনায় ফিরে সেনাপতি আবু উবাইদাহকে এ মর্মে চিঠি লিখেন-‘আপনাকে আমার খুব প্রয়োজন। আমার এ চিঠি যদি রাতে আপনার কাছে পৌঁছে, তাহলে সকাল হওয়ার আগে রওয়ানা দেবেন। আর যদি দিনে পৌছে তবে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই রওয়ান দেবেন।’

খলিফার চিঠি পড়ে সেনাপতি আবু উবায়দাহ বুঝতে পারলেন যে, খলিফা চাচ্ছেন তিনি যেন মহামারি প্লেগে আক্রান্ত না হন। অথচ সেনাপতি আবু উবায়দাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু সিরিয়ায় খলিফার রাষ্ট্রীয় সফর বাতিল প্রসঙ্গে হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি এ অভিযোগ করেছিলেন-‘হে আমিরুল মুমিনিন! আপনি কি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত তাকদির থেকে পলায়ন করে মদিনায় ফিরে যাচ্ছেন?’অথচ সেনাপতি হজরত আবু উবাইদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছ থেকে এ কথা শুনে হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কষ্ট পেলেন। প্রিয় মানুষের কাছে যেভাবে আপনজন কষ্ট পায়। কেননা হজরত আবু উবায়দাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন খলিফার অনেক পছন্দ ও ভালোবাসা পাত্র। তাছাড়া সেনাপতি আবু উবায়দাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবাদের অন্যতম একজন।

Advertisement

খলিফার চিঠির উত্তরে হজরত আবু উবায়দাহসেনাপতি আবু উবায়দাহ যখন বুঝতে পারলেন যে, খলিফা চান না তিনি মহামারি প্লেগে আক্রান্ত হন। তখন সেনাপতি খলিফার কাছে প্রতি উত্তরে এ চিঠি লেখেন-‘হে আমিরুল মুমিনিন! আমি তো আপনার প্রয়োজনটা বুঝতে পেরেছি। আমি তো মুসলিম মুজাহিদদের মধ্যে অবস্থান করছি। তাদের মধ্যে যে মুসিবত (মহামারি প্লেগে) পতিত হয়েছে, তা থেকে আমি নিজেকে বাঁচানোর প্রত্যাশী নই। আমি তাদের (মুসলিম মুজাহিদদের) ছেড়ে যেতে চাইনা। যতক্ষণ না আল্লাহ আমার ও তাদের মাঝে চূড়ান্ত ফয়সালা করে দেন।সুতরাং আমার চিঠিটি পাওয়া মাত্রই আমার প্রতি আপনার দেয়া নির্দেশ প্রত্যাহার করুন এবং আমাকে মুসলিম মুজাহিদদের সঙ্গে এখানেই অবস্থানের অনুমতি দিন।’

হাদিসের নির্দেশনা অনুসারে সেনাপতি হজরত আবু উবায়দাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর সিদ্ধান্তও ছিল সঠিক। কারণ হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণিত হাদিসটি সেনাপতির জন্যও ছিল যথাযথ- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা যখন কোনো এলাকায় মহামারি প্লেগের বিস্তারের কথা শুনো, তখন সেখানে প্রবেশ করো না। আর যদি কোনো এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব নেমে আসে, আর তোমরা সেখানে থাকো, তাহলে সেখান থেকে বেরিয়েও যেও না।’ (বুখারি)

এদিকে খলিফা হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু সেনাপতি হজরত আবু উবায়দাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু চিঠি পড়ে ব্যাকুলভাবে কান্নাকাটি করলেন। তাঁর কান্না দেখে উপস্থিত মুসলিমরা তাকে জিজ্ঞাসা করলো-‘হে আমিরুল মুমিনিন! হজরত আবু উবায়দাহ কি ইন্তেকাল করেছেন?’হজরত ওমর বললেন, ‘না’, তবে তিনি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।’

সেনাপতির ইন্তেকালজান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবি মুসলিম মুজাহিদদের সেনাপতি হজরত আবু উবায়দাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু মহামারি প্লেগ আক্রান্ত অঞ্চলে অবস্থানকালীন সময়ে কিছুদিন যাওয়ার পরই মহামারি প্লেগ-এ আক্রান্ত হন এবং শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

Advertisement

কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই ঘোষণা করেছেন- ‘মহামারিতে (প্লেগ) মৃত্যুও প্রত্যেক মুসলিমের জন্য শাহাদাত।’ (বুখারি)

মর্যাদাবান সাহাবি হজরত আবু উবায়দাহকত মর্যাদা সম্পন্ন হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে দুনিয়াতে জান্নাতের সুসংবাদ দিতে পারেন। তিনি ছিলেন আশারায়ে মুবাশশারার অন্যতম একজন। এ কারণেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর খলিফা হওয়ার জন্য হজরত আবু উবায়দাহর নাম প্রস্তাব করেছিলেন হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু।

শুধু তা-ই নয়, হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ইন্তেকালের আগে পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের প্রসঙ্গে আসলে হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন-‘যদি আবু উবায়দাহ বেঁচে থাকতেন, তাহলে কোনো কিছু না ভেবে তাঁকেই খলিফা বানাতাম।’

সুন্নাতের আনুসরণমহামারি (প্লেগ) অঞ্চলে মুসলিম মুজাহিদদের দায়িত্ব থাকাকালীন সময়ে তিনি নিজে আক্রান্ত হওয়াকেও ভয় করেননি। তিনি অভিযান থেকে মুসলিম মুজাহিদদের ফেলে খলিফার নির্দেশকে বিনয়ের সঙ্গে নিজের জন্য প্রত্যাহারের আবেদন করেন। আর এটিও ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের অনুসরণ।

মহামারি প্লেগে হজরত আবু উবায়দাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর ইন্তেকালেও রয়েছে মুসলিম উম্মাহ পুরো বিশ্ববাসীর জন্য মহান শিক্ষা। ভাইরাসে আক্রান্ত অঞ্চল ত্যাগ করে চলে না যেয়ে সেখানে অবস্থান করা। সতর্কতামূলক বিষয়গুলো মেনে চলা।

প্রাণঘাতী মহামারি করোনাভাইরাসসহ সব সংক্রামক ব্যাধিতে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনার পাশাপাশি যথাযথ সতর্কতা ও চিকিৎসা গ্রহণ করা। মহামারি করোনায় হাদিসে বর্ণিত দোয়া ও চিকিৎসা সবার জন্য গ্রহণ করা জরুরি।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহসহ বিশ্ববাসীকে করোনাসহ সব মহামারিতে যথাযথ সতর্কতাসহ কুরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। করোনাসহ সব দুর্যোগ থেকে বিশ্ববাসীকে হেফাজত করুন। আমিন।

এমএমএস/এমকেএইচ