দেশজুড়ে

বগুড়া থেকে রংপুরে শ্বশুরবাড়ি দাওয়াত খেতে গেলেন প্রবাসী

চীন, ইতালি, কুয়েত, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, কাতার, ওমান ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে শতাধিক প্রবাসী বগুড়ায় নিজ বাড়িতে এসেছেন। এদের অনেকেই করোনা আক্রান্ত দেশ থেকে এলেও হোম কোয়ারেন্টাইন মানছেন না।

Advertisement

জনসমাগম এলাকাগুলোতে ঘোরাঘুরি ছাড়াও আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে দাওয়াত খাচ্ছেন বিদেশফেরতদের কেউ কেউ। আবার অনেকেই গেছেন বাজার করতে। কোনো বাধা ছাড়াই অবাধে ঘোরাফেরা করছেন বিদেশফেরত এসব ব্যক্তি।

এদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনা এবং হোম কোয়ারেন্টাইন মানার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বগুড়ার প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ দায়সারাভাবে কাজ করছেন। এ কারণে জেলার সর্বত্র দেখা দিয়েছে প্রবাসী আতঙ্ক। অনেক স্থানে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে প্রবাসীর বাড়ি ঘেরাও করায় নতুন করে এই ভাইরাস আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

বগুড়া স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি, বুধবার (১৮ মার্চ) বিকেল পর্যন্ত জেলার আট উপজেলায় মোট ৬৯ জন প্রবাসী হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছেন নন্দীগ্রাম উপজেলায়। সেখানে ১৮ জন প্রবাসী হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন।

Advertisement

বগুড়ার সিভিল সার্জন গওসুল আজিম চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি দেশে ফেরা প্রবাসীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং স্বাস্থ্য কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। তারা সবাই সুস্থ আছেন। তাদের মধ্যে কারও শরীরে করোনার লক্ষণ মেলেনি।

তবে সরেজমিনে দেখা গেছে বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। প্রবাসীদের ৯৫ ভাগই হোম কোয়ারেন্টাইন মানছেন না। হোম কোয়ারেন্টাইন সম্পর্কে সঠিক ধারণাও তাদের নেই। অনেকেই হোম কোয়ারেন্টাইনে বসে স্ত্রী-ছেলে মেয়েসহ আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে সময় কাটাচ্ছেন।

গত ৯ মার্চ কাতার থেকে নিজ গ্রাম সোনাতলায় এসেছেন ৩৫ বছরের এক ব্যক্তি। তিনি হোম কোয়ারেন্টাইন বলতে কি জানেন না। স্বাস্থ্য বিভাগের তৈরি করা তালিকা অনুসারে তাকে দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন স্থানীয় সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক মোহাম্মদ হাসিব। কিন্তুু ওই প্রবাসী জানালেন তার কাছে স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো লোকজন আসেনি।

তিনি বলেন, ঢাকার বিমানবন্দর থেকে ছাড়ার পর আমাকে বলা হয়েছিল বাড়িতে থাকতে। আমি তাই করছি। প্রয়োজন পড়লে কেনাকাটা করতে উপজেলা সদরের বাজারে যাই আমি।

Advertisement

কুয়েত থেকে নিজ গ্রাম সোনাতলায় এসেছেন আরেক প্রবাসী (৪০)। গত ৮ মার্চ বাড়ি ফেরার পর থেকে আত্মীয়-স্বজন তার বাড়িতে আসছেন। দাওয়াত খাচ্ছেন ওই প্রবাসী।

তিনি বলেন, শারীরিকভাবে সুস্থ আমি। স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো লোক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এজন্য আমি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছি।

স্বাস্থ্য বিভাগের তৈরি করা তালিকা অনুসারে এই প্রবাসীকে দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক মেহেরুন নেছা। অথচ প্রবাসী বলেন, আমার দেখভাল করার বিষয়টি আমি তো জানি না। আমার কিসের দেখভাল।

হোম কোয়ারেন্টাইনের বিষয়ে সোনাতলা উপজেলায় সৌদি আরব থেকে ফেরা ৩২ বছর বয়সী এক যুবকের সঙ্গে কথা হয়। সাড়ে তিন বছর সৌদি থাকার পর ৭ মার্চ দেশে ফিরেছেন তিনি। এরপর হোম কোয়ারেন্টাইনের নির্দেশনা না মেনে পরিবার-পরিজন নিয়ে রংপুরে শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গেছেন তিনি। তাকে দেখভালের দায়িত্বে থাকা সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক মোহাম্মদ হাসিব ঘটনাটি জেনেছেন অনেক পরে।

একই অবস্থা সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আসা বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলায়। সেখানে স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা মানছেন না হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা প্রবাসীরা। প্রকাশ্যে হাট-বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তারা। করোনা আক্রান্ত বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরেছেন মোট ১৮ জন। তারা এখন অবাধে হাট-বাজার, চায়ের দোকানসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বারবার সতর্ক করা হলেও কারও কথায় গুরুত্ব দিচ্ছেন না তারা।

জানতে চাইলে মালয়েশিয়া থেকে আসা এক প্রবাসী বলেন, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। সকালে নিজের প্রয়োজনে বাজারে গিয়াছিলাম। কিছু কেনাকাটা করেই আবার ঘরে ফিরেছি।

কুয়েত থেকে আসা আরেক প্রবাসীকে স্থানীয় কুন্দারহাটে বাজার করতে দেখা গেছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাড়ির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে হাটে এসেছি। তবে আর বাইরে বের হব না।

ভাটরা ইউনিয়ন পরিষদের ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য (মেম্বার) জাহাঙ্গীর আলম জুয়েল বলেন, আমার ওয়ার্ডে মালয়েশিয়া থেকে আসা এক প্রবাসী জনসমাগমস্থলে প্রকাশ্যে ঘুরছেন। চা-দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন। কিন্তুু স্বাস্থ্য বিভাগ এবং পুলিশ এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

নন্দীগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার করিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তোফাজ্জল হোসেন মন্ডল বলেন, সতর্কতা হিসেবে ১৮ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। তাদেরকে বাড়ির বাইরে না যেতে বলা হয়েছে।

এদিকে মঙ্গলবার বগুড়া শহরের উত্তর চেলোপাড়ায় করোনাভাইরাস সন্দেহে ইতালিফেরত এক যুবকসহ গোটা পরিবারকে অবরুদ্ধ করে রাখে এলাকাবাসী। পরে স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তার তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।

বগুড়া পৌরসভার কাউন্সিলর পরিমল চন্দ্র দাস বলেন, ইতালিফেরত ওই যুবক উত্তর চেলোপাড়ায় থাকেন। ইতালি থেকে দেশে ফেরার পর তাকে আশকোনা হজ ক্যাম্পে রাখা হয়। পরে সেখান থেকে পালিয়ে যান তিনি। খবর পেয়ে মঙ্গলবার বিকেলে এলাকার লোকজন তার বাড়ির সামনে ভিড় জমায় এবং এলাকা ছাড়তে বলে ওই পরিবারকে।

তিনি আরও জানান, ওই প্রবাসী ও তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তাদেরকে জানিয়েছি আপনারা কেউ ১৪ দিন ঘর থেকে বের হবেন না এবং এলাকাবাসীকে এ বিষয়ে নীরব থাকতে বলেছি। ওই পরিবারের কিছু প্রয়োজন হলে ফোনে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

বগুড়া সিভিল সার্জন ডা. গওসুল আজিম চৌধুরী বলেন, উত্তর চেলোপাড়ায় আমাদের মেডিকেল টিম পরিদর্শন করে নিশ্চিত হয়েছেন ওই যুবক ইতালিফেরত। এজন্য আমরা তাদের বাড়ি থেকে বাইরে যেতে নিষেধ করে হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করেছি। আর এটা পর্যবেক্ষণের জন্য সেখানে স্বাস্থ্য কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

বগুড়ার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ফয়েজ আহম্মেদ বলেন, জেলার সার্বিক পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক আছে। প্রবাসী যারা হোম কোয়ারেন্টাইন মানবে না প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এএম/এমকেএইচ