রুচিশীল ও উদারমনা মানুষ সবসময়ই সংস্কৃতিপ্রেমী হন। বিপ্লবীরাও। অনুপ্রেরণা পেতে কর্মমুখর তুমুল ব্যস্ততার মাঝেও তারা সংস্কৃতিচর্চায় যুক্ত থাকার চেষ্টা করেন। তারা কবিতা ভালোবাসেন, তারা গান ভালোবাসেন, অভিনয় ভালোবাসেন, শিল্প ও শিল্পী ভালোবাসেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন তেমনি।
Advertisement
বঙ্গবন্ধু এ দেশের ভৌগলিক স্বাধীনতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক মুক্তি ও বিকাশেরও স্বপ্ন দেখেছেন। তাই আজীবন শিল্প ও সাহিত্যের মানুষদের তিনি ভালোবেসেছেন। বাংলাদেশের সংগীতশিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, অভিনয় শিল্পীদের সবসময় উৎসাহ দিতেন বঙ্গবন্ধু।
তিনি গান-কবিতা পছন্দ করতেন সেই প্রমাণ পাওয়া গেছে তাকে নিয়ে নানা গবেষণা ও লেখায়। জানা গেছে, রবি ঠাকুরের কবিতা ও গান তাকে খুব টানতো। ডি এল রায়ের গান তাকে মুগ্ধ করতো। লালন-হাছনদের মতো বাউলদের প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিলো। সুযোগ হলেই গুনগুন করে গাইতেন তিনি। কবিতা আবৃত্তি করতেন। সেসব ছিলো দেশপ্রেমের।
বঙ্গবন্ধু কাজী নজরুলের গান ও কবিতায় দেশকে খুঁজে পেতেন বিপ্লবী চেতনায়। তাইতো নিজ উদ্যোগেই তিনি অসুস্থ কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন। তাকে জাতীয় কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন।
Advertisement
বঙ্গবন্ধু এদেশের চলচ্চিত্রেরও স্বপ্নদ্রষ্টা। চলচ্চিত্র নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অনেক স্বপ্ন ছিলো। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি মজবুত ও মানসম্পন্ন চলচ্চিত্রের শিল্প গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি রাষ্ট্রে সাধ্যের সবটুকু নিয়েই চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তার উৎসাহ আর উদ্দীপনাতেই নতুন করে শুরু হয়েছিলো বাংলাদেশি সিনেমার যাত্রা।
তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াতের ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’ বই থেকে জানা যায়, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারকে হটিয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার আসে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায়। তখন শেখ মুজিবুর রহমান হন বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী। এ সময় ঢাকায় একটি স্থায়ী ফিল্ম স্টুডিও স্থাপনের ব্যাপারে তার সঙ্গে আলোচনা করেন আবদুল জব্বার খান, ডক্টর আবদুস সাদেক, নূরুজ্জামান প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু তাদেরকে একটি পরিকল্পনা পেশ করতে বললে তারা তা করেন। সেই প্রেক্ষিতে ৩ বছর পর ১৯৫৭ সালে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ৩ এপ্রিল প্রাদেশিক আইন পরিষদের অধিবেশনের শেষ দিন বঙ্গবন্ধু ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ বিল উত্থাপন করেন। বিলটি উত্থাপনের পর পরিষদের সদস্যরা কিছু সংশোধনী আনেন। পরে সংশোধিত বিলটি বিনা বাধায় আইন পরিষদে পাস হয়। যাত্রা করে পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা, যা আজকের বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা বা এফডিসি নামে পরিচিত। ২০১২ সাল থেকে প্রতি বছর ৩ এপ্রিলকে জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস হিসেবে উদযাপন করা হচ্ছে।
পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার প্রথম নির্বাহী পরিচালক নাজীর আহমদ ১৯৮৫ সালের ১৬ জানুয়ারি সচিত্র বাংলাদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘তার (বঙ্গবন্ধু) উৎসাহ না থাকলে বোধহয় এ দেশে এফডিসির জন্ম হতো না। আর জন্ম হলেও হতো অনেক দেরিতে।’
প্রতিষ্ঠার পরই এফডিসিতে চারটি ছবির কাজ শুরু হয়, সেগুলো যথাক্রমে আসিয়া (ফতেহ লোহানী), আকাশ আর মাটি (ফতেহ লোহানী), মাটির পাহাড় (মহীউদ্দিন) ও জাগো হুয়া সাভেরা (এজে কারদার)। প্রতিষ্ঠার পর প্রথম যে পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির প্রিন্ট করা হয়, সেটি ছিল ভারতীয় ইনসানিয়াত।
Advertisement
পাকিস্তান আমলে নানা ঘাত প্রতিঘাতে চলেছে এ দেশের চলচ্চিত্র। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু চলচ্চিত্রের মানুষদের দিয়েছিলেন পূর্ণ স্বাধীনতা। উৎসাহ-পরামর্শের পাশাপাশি নানাভাবে চলচ্চিত্রের পৃষ্টপোষকতা করেছেন তিনি। তার শাসনামলে দেশের নির্মাতা-কলাকুশলীদের বিশ্ববাসীদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে এবং বাইরের চলচ্চিত্রকে এ দেশের মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। যার মধ্যে ১৯৭৩ সালে ঢাকায় পোল্যান্ড চলচ্চিত্র উৎসব, ১৯৭৪ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসব উল্লেখযোগ্য।
বঙ্গবন্ধুর আমলে বিদেশে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র প্রতিনিধিত্ব করে ও পুরস্কারও পায়। ১৯৭২ সালের তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড পুরস্কার পায়। এটি পরে সিডালক পুরস্কারও অর্জন করে। ১৯৭৩ সালে সুভাষ দত্তের অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী মস্কো, ১৯৭৪ সালে খান আতাউর রহমানের আবার তোরা মানুষ হ ও মিতার আলোর মিছিল তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়।
বঙ্গবন্ধু বিদেশি ছবি আমদানিরও বিপক্ষে ছিলেন। কারণ তিনি জেনেছিলেন দেশের চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরা এমনটা চান না। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে উর্দু ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী নিষিদ্ধ করা হয়। একই বছর ভারত থেকে শুধু বাংলা চলচ্চিত্র আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হলে স্থানীয় চলচ্চিত্র কর্মীদের প্রতিবাদের মুখে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন বঙ্গবন্ধু। একই সময়ে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে আমদানীকৃত উর্দু, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্র এ দেশীয় আমদানিকারক ও পরিবেশকরা ‘বাংলাদেশের সম্পত্তি’ হিসেবে প্রদর্শনের অনুমতি চাইলে বঙ্গবন্ধু তাদের সে দাবি প্রত্যাখ্যান করেন।
অন্যদিকে চলচ্চিত্র রফতানি করতে বঙ্গবন্ধু ভূমিকা রেখেছিলেন। বিভিন্ন ছবি রফতানি বাবদ ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ২ হাজার, ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে ১১ হাজার ও ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ৫ হাজার ডলার আয় করতে সক্ষম হয়।
অনুপম হায়াতের লেখা সূত্রে এও জানা যায়, শত ব্যস্ততার মধ্যেও চলচ্চিত্র উপভোগ করতেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু রূপবান ছবিটি দেখেছেন। এছাড়া চিত্রগ্রাহক মাসুদ উর রহমান বলেছেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবিটিও দেখেছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ‘সংগ্রাম’ নামের একটি ছবিতে অভিনয়ও করেছেন।
ঢাকাই সিনেমাকে বিকশিত করা সফল মানুষদের মধ্যে অন্যতম অভিনেতা কামরুল আলম খান খসরু, সৈয়দ হাসান ইমাম, ফারুক, সোহেল রানারা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য।
বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে এই দেশে যে চলচ্চিত্রের প্রাতিষ্ঠানিক গোড়াপত্তন ও বিকাশ সেই চলচ্চিত্র আজ আভিজাত্য হারানো এক অতীত। মান ও দর্শকের পাশাপাশি চলচ্চিত্র তার গৌরবও হারিয়েছে। গেল কয়েক বছর ধরেই হল বন্ধের হিড়িক পড়েছে।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার সরকার সবসময়ই চলচ্চিত্র বান্ধব হিসেবে ভূমিকা রেখে চলেছে। তবুও কোনো এক চোরাবালিতে আটকে আছে ঢাকাই সিনেমা! সবাই জানেন ও বুঝেন সমস্যাগুলো তবু যেন জানেন না, বুঝেন না। সেই চোরাবালি থেকে কবে হবে উত্তরণ? সে নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে গেল কয়েক বছর ধরেই। গোল টেবিল বৈঠক হচ্ছে। মিটিংয়ের পর মিটিং হচ্ছে। কিন্তু চলচ্চিত্রের উন্নতি হচ্ছে না।
সবার প্রত্যাশা আবারও কেউ একজন আসুক বঙ্গবন্ধুর মতো নিঃস্বার্থভাবে চলচ্চিত্রকে ভালোবাসবেন। দেশপ্রেমের তাগিদে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের তাগিদে, সঠিক ও সুন্দর সংস্কৃতি চর্চার তাগিদে চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নেবেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জ্বল এমন একজন আসুক যার যোগ্য নেতৃত্বে এদেশের চলচ্চিত্র বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছুঁয়ে বাঁচবে মাথা উঁচু করে।
এলএ/জেআইএম