ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ থেকে একটু সামনে গেলেই জাতীয় পাখি দোয়েলের ডানা মেলে ভেসে থাকা ভাস্কর্যের দিকে চোখ পড়ে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুস্কর। চার রাস্তার সংযোগস্থলটি নগরবাসীর কাছে দোয়েল চত্বর মোড় নামে সুপরিচিত। সেলফি যুগের নানা বয়সী মানুষ দোয়েল চত্বরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে সংরক্ষণ করে। কিন্তু নগরবাসীর অনেকের কাছে অজানা ভাস্কর্যের পাখির ডানার নিচে মাথা গুঁজে বেঁচে থাকা এক হতদরিদ্র পরিবারের জীবন সংগ্রামের কাহিনী। কিছুদিন আগ পর্যন্ত দোয়েল চত্বরের চৌহদ্দি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকলেও বর্তমানে সংস্কার কাজের কারণে সেই প্রাচীর ভেঙে ফেলা হয়েছে। জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক কৌতূহলবশত দোয়েল চত্বরের ভাস্কর্যের নিচে চোখ রাখতেই দেখতে পান এক হতদরিদ্র পরিবারের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিক্রমপুরের বাসিন্দা ৬০ বছরের বৃদ্ধা মনোয়ারা তার ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি নিয়ে ভাস্কর্যের নিচে কোনোভাবে জীবন ধারণ করছেন। ফুটপাত থেকে কুড়িয়ে পাওয়া পলিথিন রশি দিয়ে বেঁধে ঢেকে রাখার চেষ্টা করলেও ঝড় বৃষ্টিতে পলিথিন ছিড়ে বিভিন্ন স্থানে ফুটো হয়ে গেছে। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে মনোয়ারা জানান, কুকুর, বিড়াল, ইদুর ও মশার সঙ্গে দিনরাত কাটে তাদের। দুইমাস আগে পর্যন্ত ডেমরার দেল্লা এলাকায় মাসিক এক হাজার আটশ টাকায় এক রুমের ভাড়া বাসায় ছেলে ও ছেলের বউকে নিয়ে থাকতেন। ওই সময় ছেলে রাজধানীর কাপ্তানবাজার মুরগির আড়তে চাকরি করে সংসার চালাতো। প্রতিদিন কমপক্ষে দুইশ থেকে চারশ টাকা পেতো। কিন্তু কয়েকমাস আগে ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে সংসারের চাকা অচল হয়ে পড়ে। কোনোভাবে ধার দেনা করে জীবন ধারণ করতে পারলেও পাঁচ মাসের ঘরভাড়া বাকি পড়ে। বাড়িওয়ালা দুমাস আগে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়। বউটা তখন নয়মাসের পোয়াতি। এত বড় পৃথিবীতে যাওয়ার কোন জায়গা নেই। খালি হাতে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে এসে দোয়েল চত্বরের ভাস্কর্যের নিচে বসবাস শুরু করেন। ছেলে কাপ্তানবাজার মুরগির আড়তে আবার কাজ করে। সে টাকা দিয়ে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে জীবন চলছে। মনোয়ারা জানান, রাতে পোয়াতি বউডা ঘুম থনে লাফ মাইরা উইঠ্যা সারা রাত বইয়া থাকতো। মাথার পাশে কুত্তা বিলাই শুয়ে থাকতো। মশার কামড়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ওপর দিয়ে ইদুর দৌড়ে বেড়াতো। তিনি আরো জানান, মাসখানেক আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাতির জন্ম হয়। চার সদস্যের পরিবারের সংসারে রান্নাবান্নার জন্য হাড়ি পাতিল নেই বললেই চলে। একটি মাত্র হাড়ি আর কয়েকটা পানির বোতল। মনোয়ারা জানান. একদিন ভাস্কর্যের নিচে রান্না বসালে ধোঁয়া উঠে। পুলিশ এসে তাদের ওই স্থান ছেড়ে যেতে বলে। তাই সেদিন আর চুলোতে আগুন জ্বলেনি। রান্না না হলে কীভাবে খাওয়া-দাওয়া করেন জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, প্রতিবেলা হোটেল থেকে তিনজনের জন্য ৩০ টাকার ভাত, ১০ টাকায় দুইটা আলু ভর্তা আর ১০ টাকার ডাল কিনে এনে খান। তিন বেলায় ৯০ টাকায় কোনোভাবে খেয়ে বেঁচে জীবন চলে। মাঝে মাঝে শখ হলে ১৫ টাকায় একটা ডিম কিনে ভাগ করে খান। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ছেলে কাপ্তানবাজার মুরগির আড়তে কাজে আছেন বলে জানান। ছেলের বউ ও নাতি কোথায় জিজ্ঞাসা করলে বৃদ্ধা জানান, ‘বউরে হের বইনের বাসাত পাঠাইছি। নাতিডারে দেইখ্যা যদি হের বইনে টাকাপয়সা কিছু সাহায্য করে তাইলে আবার এক রুমের বাসা ভাড়া করার চেষ্টা করমু। ইন্দুর বিলাইয়ের কামড়ে কোনদিন নাতি আমার মইরা যায় হেই চিন্তাই রাইতে ঘুম আহেনা বলে জানান মনোয়ারা। চলে আসার সময় মনোয়ারা বার বার জানতে চায়, স্যার এহানে আর কয়ডা দিন থাকতে পারুম তো? এমইউ/জেডএইচ/এএইচ/পিআর
Advertisement