দেশজুড়ে

বরইতলা গণহত্যা : বিচারের অপেক্ষায় ৩৬৫ শহীদ পরিবার

আজ ১৩ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের বরইতলা গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার বরইতলা নামক স্থানে ৩শ ৬৫ গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সে দিনের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিলেন বরইতলাসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের নিরপরাধ মানুষ। সৌভাগ্যক্রমে এখনও বেঁচে আছেন অনেকে। অনেকে আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন নৃশংস নির্যাতনের চিহ্ন। কান্না থামছে না শহীদদের স্বজনদের। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হয়নি। বরইতলা হত্যাকাণ্ডে স্বজনহারা শত শত পরিবার এখনও মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তাদের খবর রাখে না কেউ। এখনও মিলেনি শহীদ পরিবারের মর্যাদা। ১৯৭১ সালের উত্তাল অক্টোবর। স্বাধীনতার জন্য বাঙালি দামাল ছেলেরা জীবন বাজী রেখে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে। পাক হানাদার বাহিনী ও এ দেশের স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার, আল বদর সারাদেশে নির্বিচারে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ চালাচ্ছে। ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর। রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকাল। ট্রেনে করে ১৫/২০ জন পাক মিলিশিয়া ও বিপুল সংখ্যক রাজাকার যশোদল ইউনিয়নের বরইতলা নামক স্থানে এসে নামে। পাক মিলিশিয়া ও রাজাকারেরা পার্শ্ববর্তী দামপাড়া গ্রামে প্রবেশ করে ৪/৫ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করে। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রাণে বাঁচতে কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের দামপাড়াসহ কড়িয়াইল, তিলকনাথপুর, গোবিন্দপুর, চিকনিরচর, কালিকাবাড়ি, ভুবিরচরসহ আশপাশের গ্রামের লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য নরসুন্দা নদীর বাঁকে একটি আঁখ ক্ষেতের পাশে এসে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে রাজাকার ও পাক মিলিশিয়ারা তাদের ধরে এনে বরইতলা এলাকায় রেললাইনের পাশে জড়ো করে। নিরপরাধ গ্রামবাসীকে এক সঙ্গে জড়ো করে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। ঠিক সে সময় এক রাজাকার মিলিশিয়াদের কাছে এসে খবর দেয় যে, গ্রামবাসী একজন পাক মিলিশিয়াকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলেছে। এ গুজবের সত্যতা যাচাই না করেই পাক মিলিশিয়া হিংস্রতায় মেতে ওঠে।বর্বর পাক মিলিশিয়া ও তাদের আজ্ঞাবহ রাজাকার বাহিনী জড়ো করা নিরীহ গ্রামবাসীকে কিশোরগঞ্জ-ভৈরব রেললাইনের পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, লোহার রড এবং রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডে ৩শ৬৫ জন গ্রামবাসী প্রাণ হারান। বরইতলায় শহীদ হওয়া ৩শ৬৫ জন গ্রামবাসীর মধ্যে সবার নাম পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর এলাকাবাসী বরইতলার নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদনগর’ নাম রাখে। স্থানীয় অধিবাসীদের উদ্যোগে নির্মিত হয় একটি স্মৃতিফলক। পরে ২০০০ সালে বড়ইতলা এলাকায় রেললাইনের পাশে ৬শ৬৭ বর্গফুট এলাকায় ২৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। চিকনিরচর গ্রামের মোমতাজ উদ্দিন ও তার ভাই সরাফ উদ্দিনকে শত শত গলিত মৃতদেহের ভেতর থেকে একদিন পর জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে তার আত্মীয় স্বজন। মোমতাজের মাথার বাম পাশ বেয়নেটের খোচায় এখনও গর্ত হয়ে আছে। গলায় বেয়নেটবিদ্ধ হওয়ায় ভালো করে কথা বলতে পারেন না তার বড় ভাই সরাফ উদ্দিন। দামপাড়া গ্রামের আবদুর রহিমকেও মৃতপ্রায় অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। কয়েক বছর আগে তার মৃত্যু হয়। তার ভাই, ভাতিজাসহ ৪ জনকে হত্যা করা হয় বড়ইতলায়। সে সময় আব্দুল আজিজ কিশোরগঞ্জ শহরের আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে তিনি বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। কিন্তু সে দিনের বর্বরোচিত ঘটনার প্রসঙ্গ উঠতেই লাল হয়ে উঠে তার চোখ। যেন আগুন ঝরে তাঁর দু’চোখ দিয়ে। শহরে থাকায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও হারাতে হয়েছে তার ভাই, চাচাসহ পরিবারের ৪ জনকে। আবদুল আজিজ জানান, সেদিন সারা এলাকায় যেন কিয়ামত নেমে আসে। লাশ দাফন করার মতো কেউ ছিল না। মিলিশিয়া আর রাজাকারের ভয়ে অনেকে নদীতে স্বজনের মরদেহ ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। নিজের চোখে ২৫/৩০টি লাশ নরসুন্দা নদীতে ভাসতে দেখেছি বলেন এ সাবেক শিক্ষক।এ রকম অসংখ্য শহীদ পরিবারের ভয়াল স্মৃতি বেদনাগাঁথা মিশে আছে কর্ষাকড়িয়াইল ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের ঘরে ঘরে। বিনা অপরাধে শত শত গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যার ক্ষত ভুলতে পারছে না তাদের স্বজনেরা।প্রতি বছর ১৩ অক্টোবর স্মৃতিসৌধের শুকনো ইট ভিজে যায় শত শত স্বজনহারার চোখের জলে। এলাকাবাসী শহীদ দিবসে ফুলের তোড়া দিয়ে শ্রদ্ধা জানান শহীদদের প্রতি। স্থানীয়ভাবে আয়োজন করা হয় আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। জাতীয় শোক দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেও সরকারিভাবে এখানে অর্পণ করা হয় পুস্পার্ঘ্য। কিন্তু বরইতলা গণহত্যায় নিহত পরিবারগুলোর অনেকের দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৩ বছর পরও স্বজনহারা পরিবারগুলোর খোঁজ নেয়নি কেউ। জোটেনি শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি কিংবা সরকারি সংবর্ধনা। তবে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার- আলবদরদের বিচার হবে বাংলার মাটিতে এ আশা নিয়েই বেঁচে আছেন শহীদের স্বজনেরা।নূর মোহাম্মদ/এসএস/এমএস

Advertisement