অর্থনীতি

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং নিয়ে বিপাকে বিনিয়োগকারীরা

>> পরিচালক-পরিচালকে লোপাট ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি!>> ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার তাগিদ >> পি কে হালদারের মতো লোকরা কীভাবে দলেবলে ঢুকল? >> জনগণের আমানত রক্ষায় ব্যর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকও

Advertisement

পিপলস লিজিংয়ের পর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের শেয়ার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার কিনে বড় ধরনের লোকসানে রয়েছেন বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ।

এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের পদ থেকে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের পদত্যাগ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আরও আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে।

এর আগে আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে নানা সংকটে পড়া পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের কার্যক্রম বন্ধের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে পুঁজিবাজারে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের ব্যাপক দরপতন হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে গত বছরের ১৪ জুলাই থেকে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার লেনদেন বন্ধ করে দেয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। পিপলস লিজিংয়ের বিষয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না আসায় প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার লেনদেন বন্ধই রয়েছে।

Advertisement

পিপলস লিজিংয়ের পর ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের বিষয়ে নানা অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসায় তা সার্বিক পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনা সার্বিক পুঁজিবাজারে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাজার ভালো করতে হলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক রকিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিংয়ের লুটপাট অথবা অবসায়ন পুঁজিবাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। একইভাবে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় অরাজকতাও পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

তিনি বলেন, এক ব্যাংকের পরিচালক অপর এক ব্যাংকের পরিচালকের সঙ্গে যোগসাজসে এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছেন। জাতি জানতে চায়, পরিচালকরা পারস্পরিক যোগসাজশে যে টাকা নিয়ে গেছেন, তারা কি আদৌও সেই টাকা শিল্পায়নে বিনিয়োগ করেছেন? তারা কি আদৌও এ টাকা পরিশোধ করেন? না-কি তারা এ টাকা অবলোপনের মাধ্যমে দায়মুক্তি নিয়েছেন? তাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে ম্যানেজমেন্ট আইনি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি? জাতি এসব প্রশ্নের জবাব চায়।

তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের পরিচালকরা নামে-বেনামে অথবা আত্মীয়স্বজন বা ভুয়া কোম্পানি দেখিয়ে অথবা তাদের কর্মচারীর নামে টাকা নিয়ে থাকলে সেই তথ্য সবার সামনে প্রকাশ করতে হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ব্যাংক-ব্যবস্থায় সুশান প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে বা দক্ষ ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে ব্যাংক পরিচালনা করতে না পারলে এবং ব্যাংক-ব্যবস্থায় জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে না পারলে পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব থেকেই যাবে।

Advertisement

‘যারা নামে-বেনামে খেলাপি হয়েছেন তাদের আইনের আওতায় এনে অবশ্যই টাকা আদায় করতে হবে। কারণ এই টাকা আমানতকারীদের, এটা তাদের টাকা নয়। সুতরাং এটা করতেই হবে। এটা করা গেলে ব্যাংক-ব্যবস্থার ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে এবং পুঁজিবাজার গতিশীল হবে’- বলেন এই পুঁজিবাজার বিশ্লেষক।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শনে উঠে এসেছে, প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ঋণের নামে এক হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা বের করে নেন। তিনি এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি থাকা অবস্থায় ২০১৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের শেয়ার কিনে কর্তৃত্ব নেন। এরপর এসব ঋণ নেন। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পাশাপাশি পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস’র নিয়ন্ত্রণও নেন পি কে হালদার।

প্রতিষ্ঠানটির এসব অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসলে শেয়ারের দামে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ধারাবাহিকভাবে কমে বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম চার টাকায় নেমে আসে। অথচ এক বছর আগেও কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল প্রায় ২০ টাকা।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের ১৭ জানুয়ারি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের শেয়ারের দাম ছিল ১৭ টাকা। এখান থেকেই শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দরপতন। টানা কমে এপ্রিলে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ১০ টাকার নিচে নেমে আসে। তবে মে ও জুন মাসে শেয়ারের দাম কিছুটা বেড়ে আবার ১০ টাকার ওপরে যায়। ১২ জুন শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ১২ টাকা ১০ পয়সা।

এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগ নেয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে পিপলস লিজিংয়ের পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের শেয়ারের দামেও নেতিবাচক প্রভাব পড়া শুরু হয়। টানা কমতে থাকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের শেয়ারের দাম। গত বছরের জুনের পর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম আর অভিহিত মূল্যের ওপরে উঠতে পারেনি।

শেয়ারের দামের এমন করুণ দশার মধ্যে গত ১ মার্চ স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যানের পদ থেকে আদালতের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। যাকে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ১৯ জানুয়ারি থেকে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেন। হাইকোর্টের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ ডেপুটি গভর্নর।

ইব্রাহিম খালেদ কোম্পানিটি থেকে পদত্যাগের পর শেয়ারের দামে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে ৯ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম তিন টাকা ১০ পয়সায় নেমে আসে। যদিও চলতি সপ্তাহে শেয়ারের দাম কিছুটা বেড়ে চার টাকায় উঠে আসে। তবে বিনিয়োগকারীরা এখনও বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে রয়েছেন।

সুমন নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, আমি ১২ টাকা করে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের শেয়ার কিনেছিলাম। শেয়ার কেনার পর থেকেই দাম কমতে থাকে। এরপর তো একের পর এক অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার কিনে বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে রয়েছি। কীভাবে এ লোকসান কাভার দেব বুঝতে পারছি না। এর আগে পিপলস লিজিংয়ের শেয়ারে বড় ধরনের ধরা খায়।

২২১ কোটি ৮১ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের মোট শেয়ারের সংখ্যা ২২ কোটি ১৮ লাখ ১০ হাজার ২৪৭টি। এর মধ্যে ৪১ দশমিক ৫৪ শতাংশ আছে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে। বাকি শেয়ারের মধ্যে ৩১ দশমিক ৬১ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে। ২৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ বিদেশিদের কাছে আছে।

ডিএসইর এক সদস্য বলেন, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের শেয়ার কিনে শুধু সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নয়, প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও ধরা খেয়েছেন। কোম্পানিটির বিষয়ে যে তথ্য বেরিয়ে আসছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, পিপলস লিজিংয়ের মতোই করুণ দশা এই কোম্পানির। কাজেই কোনো বুদ্ধি ও বিবেকসম্পন্ন বিনিয়োগকারী এখন এই শেয়ার কিনবেন বলে মনে হয় না।

পদত্যাগের পর ইব্রাহিম খালেদ বলেন, নাগরিক হিসেবে আদালতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমি দায়িত্ব নিয়েছিলাম। তবে এ প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের যে ঝামেলা, সেটি বহন করার মতো স্বাস্থ্যগত অবস্থা আমার নেই। যে কারণে পদত্যাগ করেছি।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ঘটনার চার বছর পরও বাংলাদেশ ব্যাংক কেন ব্যবস্থা নেয়নি— তা দেখার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, মাহবুব জামিলের মতো নামিদামি লোককে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে সরিয়ে পি কে হালদাররা দলেবলে ঢুকল এবং সব পরিবর্তন করে ফেলল; বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর এড়িয়ে এসব কীভাবে সম্ভব? কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে জনগণের আমানত রক্ষার দায়িত্ব তো তাদের (বাংলাদেশ ব্যাংকের)। এ ক্ষেত্রে তাদের দুর্বলতা দেখা গেছে।

তিনি আরও বলেন, পি কে হালদার অনেক টাকা পাচার করে নিজেও বাইরে চলে গেছেন বলে শুনেছি। যে প্রতিষ্ঠানের টাকা পাচার হয়ে গেছে, তা উদ্ধার করা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এটা দেখবে দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন)। আর প্রতিষ্ঠান রক্ষায় কাজ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এমএএস/এমএআর/এমএস