কথায় বলে, মানির অপমান বজ্রাঘাত তুল্য। এই লাইনটি লিখতে গিয়েই রইজ উদ্দিনের কথা মনে পড়লো। আমরা সবাই তার স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্তির বিরোধিতা করেছি, পদকপ্রাপ্তি থেকে নাম প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে বইমেলায় কথা বলেছি, ফেসবুকে বলেছি এবং সেটা যথার্থই ছিল। যাক অবশেষে তার নামটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু এখন কিঞ্চিৎ ভেবে খারাপ লাগছে এই বয়সে এসে একটা লোককে অপমান করাটাও রাষ্ট্রের পক্ষে কতোটা শোভনীয়। অবশ্য যদি আমরা ভেবে থাকি এটি একটি সভ্য রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র সম্মান দিতে জানে।
Advertisement
যে কোনো পুরস্কার প্রাপ্তিইতো আনন্দের। কিন্তু সেটি দেয়ার সময় লক্ষ্য রাখতে হয় যেন অপাত্রে দান না হয়, বানরের গলায় যেন মুক্তার হার না পড়ে। সেটি যদি হয়ে থাকে তবে সমূহ বিপদ। বিশেষ করে স্বাধীনতার মতো আবেগের সাথে জড়িত বিষয়টি নিয়ে। আমাদের দেশে সম্ভবত স্বাধীনতা পুরস্কারটি নিয়েই সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়েছে, এর কারণ নানা বিতর্কিত ব্যক্তিকে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছে। অথচ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এমন পদক পাওয়ার জন্য এখনো এমন অনেক ব্যক্তি রয়ে গেছেন যারা দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। যাদেরকে সবাই চিনেন, জানেন কিন্তু চেনেন না শুধুমাত্র যারা পদক দেয়ার জন্য নির্বাচন করেন বা সরকারের হোমড়া, চোমড়ারা যারা পদকদানের কমিটিতে থেকে যাচাই বাছাই করেন। আর এমন গুণিদেরতো অবসর নেই যে, পুরস্কারের জন্য লবিং করবেন। সরকারের মন্ত্রী বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে ধর্না দেবেন। কাজেই কাজ করে গেলেও তাদের আর পুরস্কার মেলে না।
অথচ যে কথা বলছিলাম, স্বাধীনতা, একুশে পদক এর মতো পুরস্কারগুলো বারবার বিতর্কিত হয়েছে এদেশে। আবার পুরস্কার নিয়ে যে বিতর্ক হবে না এমনও নয়। বারেক ওবামা যখন শান্তিতে নোবেল পান বা অর্থনীতির বদলে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার যখন ড. ইউনূস পান তখনও বিতর্ক হয়। পিটার হান্ডকের মতো লেখক, যিনি বসনীয়-সার্ব সৈন্যদের যুদ্ধাপরাধকে অস্বীকার করেন, এটাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন, তিনি যখন নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পান তখন পৃথিবী জুড়ে প্রতিবাদ আসে।
আমাদের দেশে সামরিক শাসকের দোসর ও স্বাধীনতাবিরোধীরা এই পুরস্কার মাহবুবুল আলম চাষীর হাতে তুলে দিয়েছিল। সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু নামে এক নৌ-কর্মকর্তার স্ত্রীকেও এই পুরস্কার দেয়া হয়। পাকিস্তানের দোসর রাজাকার শর্ষিনার পীরকে পুরস্কার দেয়া নিয়েও চলে বিতর্ক। এই লোকটাকে নিয়ে যখন হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন তখন পত্রিকাগুলো ছাপেনি। শর্ষিনার পীরের কথা বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তেও আছে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময়কার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘কয়েকটি সভায় বক্তৃতা করে বুঝতে পারলাম, ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করবেন। জামান সাহেব ও মুসলিম লীগ যখন দেখতে পারলেন তাদের অবস্থা ভালো নয়, তখন এক দাবার ঘুঁটি চাললেন। অনেক বড় বড় আলেম, পীর ও মওলানা সাহেবদের হাজির করলেন। আমাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে।’ শর্ষীনার পীর সাহেব, বরগুনার পীর সাহেব, শিবপুরের পীর সাহেব, রহমতপুরের শাহ সাহেব সকলেই আমার বিরুদ্ধে যত রকম ফতোয়া দেওয়া যায় তা দিতে কৃপণতা করলেন না।’অযোগ্য ব্যক্তির কাছে পুরস্কার যাওয়ার এমন উদাহরণ অনেক রয়েছে।
Advertisement
গত ২০শে ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২০ পাওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ যে তালিকা প্রকাশ করে, তাতে রইজ উদ্দিন আহম্মদকে সাহিত্য ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেয়া হয়। তালিকায় মোট নয় ব্যক্তি এবং একটি প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল। এরপর থেকে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এর অবশ্য প্রধানকারণ, দেশের সাহিত্যের যারা খোঁজ খবর রাখেন তাদের কেউ রইজ উদ্দিনের নাম শোনেননি। তার সাহিত্যকর্ম সম্পর্কেও বিশেষ জানা যায় না।
খোদ বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ফেসবুকে এক পোস্টে লেখেন, ‘এবার সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পেলেন রইজ উদ্দিন, ইনি কে? চিনি না তো। কালীপদ দাসই বা কে! হায়! স্বাধীনতা পুরস্কার!’ এমন মন্তব্য করেছেন অনেক গুণিজন। কিন্তু মজার বিষয়টা হচ্ছে, এই পুরস্কার ঘোষণার আগে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ সব মন্ত্রণালয় থেকে নাম চান। সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, নিজ মন্ত্রণালয়ে যোগ্য কোনও প্রার্থী আছেন কিনা তা খুঁজে দেখার জন্য ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী আগ্রহ প্রকাশ করলে এ পুরস্কারের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম আহ্বান করেছিল ভূমি মন্ত্রণালয়। ওই মন্ত্রণালয়ের অধীন ভূমি সংস্কার বোর্ডে তখন কর্মরত ছিলেন লেখক এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদ। তিনি নিজেই এ পুরস্কারের জন্য সাহিত্য শাখায় মনোনয়ন চেয়ে আবেদন করেন।
আবেদনপত্রটি কোনও প্রকার যাচাই বাছাই না করেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠায় ভূমি মন্ত্রণালয়। পরবর্তীতে স্বাধীনতা পদকের জন্য মন্ত্রিপরিষদের গঠিত কমিটি রইজ উদ্দিনকে সাহিত্যে স্বাধীনতা পদকের জন্য মনোনীত করে। কিন্তু কথা হলো সভায় উপস্থিত থাকা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা কর্মকর্তারা ছিলেন তারা কী করছিলেন সেখানে জানা মুশকিল। নইলে কীভাবে রইজ উদ্দিন পুরস্কার পান। কারণ অতীতেও এমন রইজ উদ্দিনরাই পুরস্কার পেয়ে আসছেন।
একজন মানুষ নিজের জন্য পুরস্কার চেয়ে আবেদন করতেই পারেন, কিন্তু তাকে নির্ধারণ করেছে রাষ্ট্র এবং সেটি করে পুরস্কারটিকে বিতর্কিত করেছে। একইসঙ্গে আবার পুরস্কারটি প্রত্যাহার করে তাকে অপমানও করা হয়েছে। তিনি নিশ্চয় এর মধ্যে আনন্দের সাগরে ভাসছিলেন, নানা পরিকল্পনা করছিলেন। পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে নানা জনের কাছে গর্ব করে বেড়াচ্ছিলেন। এখন তিনি কষ্টে মুখ লুকাবেন। পুরস্কার প্রাপ্তিতে যেমন সাধারণ মানুষ কষ্ট পেয়েছেন এখন পুরস্কার কেড়ে নেয়ার ঘোষণায় রইজ উদ্দিন কষ্টে ভুগছেন। এই দায় কিন্তু পুরোটাই রাষ্ট্রের।
Advertisement
জীবনসায়ান্মে এসে একজন প্রবীণ নাগরিককে অপমানের শিকার হতে হলো। অথচ বিচার হওয়া উচিত যারা এই মানুষটিকে নির্বাচন করেছিল তাদের খামখেয়ালিপনার জন্য। তাদের মোটিভ কী ছিল তা তদন্ত হওয়া দরকার। রইজ উদ্দিনের উচিত হবে মানহানির মামলা করা। আপনি কাউকে সম্মান করতে না পারেন অপমান করার অধিকার কি আছে? অথচ রইজ উদ্দিনকে আজীবন অপমান আর অসম্মানের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
এইচআর/এমএস