বাংলার ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর নাম। এদের মধ্যে পিরোজপুর অন্যতম। পিরোজপুর জেলা হিসেবে ১৯৮৪ সালে স্বীকৃতি পেলেও অনেক আগে থেকেই এলাকাটি দেশের ইতিহাস আর ঐতিহ্যর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। জানা গেছে, সুলতান ফিরোজ শাহ্ এর নাম অনুসারে নামকরণকৃত জেলাটিতে জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য জালের মত নদী-নালা আর খাল বিল। পিরোজপুর জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অনেক আগে থেকেই এখানে গড়ে উঠেছিল অনেক স্থাপনা যেগুলো এখনও এখানকার মানুষকে পুরনো ইতিহাসের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তবে রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির অভাবে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অনেক স্থাপনা। এভাবে চলতে থাকলে হয়ত আর অল্প সময়ের মধ্যেই ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাবে এসব স্থাপনা। আর নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা থাকবে এসব ইতিহাস আর ঐতিহ্যের কাহিনী। পিরোজপুরে পুরনো স্থাপনার মধ্যে কাঠের তৈরি মমিন মসজিদ, রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি, পিরোজপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ এবং কুলুবাড়ি মন্দির বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মমিন মসজিদ : পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার সর্ব উত্তর দিকে বুড়িরচর গ্রামে অবস্থিত আকন বাড়ি। ওই বাড়ির পূর্ব পুরুষেরা প্রায় দুইশত বছর আগে কাঠের মনোমুগ্ধকর কারুকার্য দিয়ে তৈরি করেছিলেন একটি মসজিদ যা মমিন মসজিদ নামে পরিচিত। মসজিদটির এমন শিল্পকর্ম বাংলাদেশের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি। তাই এটি সংরক্ষণের জন্য সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৭ এপ্রিল ২০০৩ তারিখের প্রজ্ঞাপনমূলে ‘সংরক্ষিত প্রত্ন সম্পদ’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে তাদের তালিকাভুক্ত করেছে। রায়েরকাঠী জমিদার বাড়ি : পিরোজপুর পৌর এলাকায় অবস্থিত সাড়ে তিনশত বছরের পুরনো রায়েরকাঠী জমিদার বাড়ি। ৮০ একর জমির ওপর ১৬শ শতকের মাঝামাঝির দিকে নির্মিত পুরানো প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে রায়ের কাঠি জমিদার বাড়িতে। কথিত আছে, বার ভূঁইয়ার অন্যতম মহারাজ কিংকর রায়ের বংশধর রাজা রুদ্র নারায়ণ রায় স্বপ্নে অদিষ্ট হয়ে ১৬৫৮ সালে তৈরি করেন মনোরম সৌন্দর্যের জমিদার বাড়ি। জেলা সদরের পুলিশ লাইন্স সড়কের পাশে অবস্থিত জমিদার বাড়িতে রয়েছে জাতীয় জাদুঘরের স্বীকৃত দেশের সর্ববৃহৎ ৪০ মণ ওজনের শীব লিঙ্গসহ ওই আমলের তৈরি একটি মন্দির এবং একটি কালি মন্দির। তবে রক্ষণাবেক্ষণ ও সরকারি তদারকির অভাবে রায়েরকাঠি জমিদার বাড়িটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। সবুজে ঘেরা এই বাড়িটি ঠিকমত তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে এটি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে বলে এলাকাবাসী মনে করেন। কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ : পিরোজপুর জেলা শহরে অবস্থিত কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। একশ উনত্রিশ বছর আগে ইংরেজি ১৮৮২ সালে ভারত বর্ষের উত্তর প্রদেশের জৈনপুর জেলা সদরের জনৈক হাফেজ মো. সোলায়মান এই ঐতিহাসিক জামে মসজিদটি পিরোজপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে ২০ শতক জমি ক্রয় করে গোলপাতার ছাউনি দিয়ে একটি কাঠের ঘরে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নামাজ আদায় শুরু করেন। এরপর ১৮৯৫ সালের দিকে গোলপাতার ঘরটিকে পর্যায়ক্রমে পাকা দালানের মসজিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রথমে হাফেজ মো. সোলায়মান তার প্রতিষ্ঠিত মসজিদের মোতাওয়ালী, মুয়াজ্জিন ও পরে ইমাম হিসেবে ৪০ বছর যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি বার্ধক্যে পৌঁছালে ১৯১৮ সালে তার ছোট ছেলে হাফেজ মো. নোমানকে জৈনপুর থেকে পিরোজপুর নিয়ে আসেন এবংমসজিদের সকল দায়িত্ব তার ওপর অর্পণ করেন। বর্তমানে মসজিদ পরিচালনা কমিটি এর রক্ষণাবেক্ষণের দয়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে মসজিদটি ব্যাপকভাবে সংস্কার করে ‘কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে প্রতিদিন সহস্রাধিক মুসলমান নামাজ আদায় করেন।কুলুবাড়ি মন্দির : প্রায় দুশ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার মিরুখালী ইউনিয়নের কুলুবাড়ি (বর্তমান রায়বাড়ি) মন্দির। মন্দিরের পাশেই রয়েছে নান্দনিক নির্মাণশৈলী আর দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যখচিত দুটি বিশালাকৃতির অট্টালিকা, একটি অপূর্ব নঁকশাখচিত দুর্গামন্দির ও বেশ কয়েকটি মঠ। আরো রয়েছে সুরম্য ভবন যেগুলো বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত রয়েছে। এদের মধ্যে একটি ভবনে বংশানুক্রমে কয়েকটি পরিবার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে। আবার অনেকেই দুর্ঘটনার আশঙ্কায় ভবন ছেড়ে পাশে আলাদা থাকার জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। ভবনগুলোর একটির তলদেশে রয়েছে একটি সুড়ঙ্গ, যা দিয়ে এক পাশ থেকে অন্য পাশ দেখা যায়। পরিত্যক্ত মূল ভবনের ভেতরে একটি অন্ধকার কূপ রয়েছে। কথিত আছে সেখানে অপরাধী প্রজাদের শাস্তি দেয়া হতো। জনশ্রুতি আছে, প্রায় দুশ বছর আগে বরিশাল থেকে বৃন্দাবন চন্দ্র কুলু নামক একজন ব্যবসায়ী এখানে আসেন ব্যবসার উদ্দেশ্যে। তখন থেকেই এই বাড়ির গোড়াপত্তন শুরু হয়। বৃন্দাবনের তিন ছেলে পূর্ণচন্দ্র রায়, মহেশচন্দ্র রায় ও গুরুচরণ রায়ের মধ্যে বড় ছেলে পূর্ণচন্দ্র রায় তখনকার জমিদারদের নিকট থেকে এ এলাকার জমিদারি পত্তন লাভ করেন। তখন থেকেই তারা রায় পদবি ব্যবহার করতে শুরু করেন। কুলুবাড়ির বিশাল প্রাসাদ এবং নয়নাভিরাম মন্দির তিনিই নির্মাণ করেন। নলিনী রঞ্জন রায় এলাকার উন্নয়নে সামাজিক উদ্যোগমূলক অনেক কাজ করে গেছেন। ওই এলাকায় মিরুখালী বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজে এই জমিদার বংশের অবদান ইতিহাস স্বীকৃত। কুলু বংশের নানা জনসেবামূলক কর্মকাণ্ড এখনও এ এলাকায় দৃশ্যমান। কথিত রয়েছে, কুলুবাড়ির মাটির নিচে মাটির কলসি ভর্তি প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা আর নানা দামি অলঙ্কার গচ্ছিত ছিল। ওইসব ধনসম্পদের কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও স্থাপনাগুলো এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিরুখালীর কুলুবাড়ির স্থাপনাগুলো অপরূপ কারুকার্য খচিত হলেও, বর্তমানে মন্দিরটির মূলভবন, মন্দির এবং মঠ সংস্কারের অভাবে প্রতিনিয়ত ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছে। খসে পড়ছে দেয়ালের বিভিন্ন অংশ।কুলু বংশের বংশধর পংকজ রায় এ প্রতিনিধিকে বলেন, এ অঞ্চলে এমন স্থাপনার মন্দির দ্বিতীয়টি নেই। এটি এই জনপদের একটি দর্শনীয় স্থান। তাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া এসব স্থাপনা সংস্কারের আর্থিক অবস্থা তাদের নাই। তাই এটিকে সংরক্ষণের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। আর এই বাড়িটিকে সংস্কার করা হলে এটি হয়ে উঠবে দক্ষিণাঞ্চলের একটি আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান। এসএস/এমএস
Advertisement