চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। বিশ্বে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৫৬ হাজার ৫৬৮ জন প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এতে প্রাণ গেছে ৫ হাজার ৮৩৬ জনের। বিশ্বের ১৫২টি দেশ ও অঞ্চলে করোনার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে।
Advertisement
শুধু চীনের মূল ভূখণ্ডেই আক্রান্তের সংখ্যা ৮০ হাজার ৮২৪ এবং মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ১৯৯ জনের।
চীনের পর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ইতালিতে। সেখানে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ১৫৭ জন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ১ হাজার ৪৪১ জন।
দেশে নভেল করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচজন রোগী (ইতোমধ্যে তিনজন সুস্থ হয়েছেন) শনাক্ত হলেও উচ্চমাত্রার এ ছোঁয়াচে রোগটি নিয়ে জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক রয়েছে। তবে দেশে যাতে এ রোগ ছড়িয়ে না পড়ে এজন্য সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
Advertisement
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় গত ২১ জানুয়ারি থেকে রোগটি প্রতিরোধে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, স্থল, সমুদ্র ও রেলস্টেশন দিয়ে দেশে প্রবেশকারী দেশি-বিদেশি নাগরিকদের থার্মাল স্ক্যানার ও হ্যান্ড ইনফ্রারেড থার্মোমিটারে জ্বর পরিমাপসহ হেলথ স্ক্রিনিং, হেলথ ডিক্লারেশন কার্ডসহ একাধিক কার্ডের মাধ্যমে যাত্রীদের ভ্রমণ ইতিহাস সংরক্ষণ, রোগব্যাধির বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ, করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য রাজধানীসহ সারাদেশে হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট খোলা, চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ, তাদের জন্য যথেষ্ট সুরক্ষা সামগ্রী প্রস্তুতি রাখা, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) হটলাইন চালু এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মোট তিনটি কমিটি গঠন করা হয়ছে।
চীনের উহান থেকে ৩১২ বাংলাদেশি নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে এনে আশকোনা হজ ক্যাম্পে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। গত একমাসে চীন, ইতালি, সিঙ্গাপুসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় সাড়ে চার লাখ দেশি-বিদেশি নাগরিক দেশে ফিরেছেন। তাদের সবার স্ক্রিনিং করা হয়।
তবে সরকারের এত উদ্যোগেও জনমনে আতঙ্ক দূর হচ্ছে না। করোনাভাইরাস সংক্রমণের বৈশ্বিক ও দেশের সংক্রমণের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানাতে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং করে তথ্য দেয়া হলেও বেশিরভাগ মানুষের ধারণা, সরকার তথ্য গোপন করছে। তারা বলছেন, আক্রান্ত ও মৃত্যুঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দেশের বিভিন্ন এলাকা লকডাইন (অবরুদ্ধ) করে দেয়া উচিত।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্য সচিব (সেবা বিভাগ) আসাদুল ইসলাম ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ একাধিকবার গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ দেশের কোথাও লকডাউন করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
Advertisement
কখন কোন পরিস্থিতিতে একটি নির্দিষ্ট এলাকা বা দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করা হয়-এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য মহাপরিচালক বলেন, ‘দেশে যদি ইমপোর্টেড (বিদেশফেরত যাত্রীর যদি করোনার লক্ষণ বা উপসর্গ থাকে অথবা নমুনা পরীক্ষায় তার দেহে যদি করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়) কেস থাকে কিন্তু তার মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে না ছড়ায়, তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তিকেই শুধুমাত্র হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে। তার সংস্পর্শে যেন পরিবারের সদস্যরাও কেউ না আসে সেদিকে নজর রাখতে হয়। (এই অবস্থায়) স্কুল, কলেজ কিংবা এলাকা লকডাউন করতে হয় না।’
‘দেশে যে পাঁচজন রোগী পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে একজন ইতালিফেরত যাত্রীর সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হন। এই লোকাল ট্রান্সমিশন পরিবারের সদস্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কোনো পরিবারে এক বা একাধিক ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত থাকলেও তাদের পরিবারের বাইরে অন্য কারো মাধ্যমে যদি কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে ওই কমিউনিটি পুরোটাই লকডাউন করতে হবে। ১৪ দিন নজরদারিতে রাখতে হবে’-যোগ করেন স্বাস্থ্য মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, ‘যখন দেশেরও কোনো এলাকার বিভিন্ন স্থানে একসঙ্গে ১০ জনের বেশি করোনাভাইরাস ধরা পড়ে, তখন ওই নির্দিষ্ট থানা, জেলা কিংবা শহর কোয়ারেন্টাইন করতে হবে। স্কুল ও কলেজ বন্ধ ঘোষণা করতে হবে। বাংলাদেশেরও কোথাও এখন পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।’
ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এতদিন শুধুমাত্র বিদেশফেরত সন্দেহভাজন নাগরিকদের নমুনা সংগ্রহ করে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করা হলেও বর্তমানেও দেশের কোথাও স্থানীয়ভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে কি-না, তা খতিয়ে দেখতে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে নিউমোনিয়া ও জ্বর আক্রান্তদের নমুনা সংগ্রহ করে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ নমুনা পরীক্ষায় স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ ঘটেছে কি না তা জানা সম্ভব হবে।’
এখন পর্যন্ত সরকার যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তাতে করোনাভাইরাস ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারবে না বলে মনে করেন আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক ডা. মোশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘বিদেশ থেকে ফেরত আসা নাগরিকরা যাতে ১৪ দিন বাড়িতে সেলফ কোয়োরেন্টাইনে থাকেন, সেজন্য জেলা, উপজেলার শীর্ষ কর্মকর্তা এমনকি স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যান, মেম্বার ও সাধারণ জনগণ সচেষ্টা রয়েছেন।
এমইউ/এসআর/এমএস