একজন মানুষ ঘরের ভেতরে একা একা মরে পড়ে আছেন। কেউ জানে না। যখন দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠলো, তখন টের পেলেন প্রতিবেশীরা। দরজা ভেঙে অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করলো পুলিশ। তারপর ‘মর্গে গিয়ে হৃদয় জুড়োলো’। ‘মর্গে— গুমোটে থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে।’…
Advertisement
এই মহানগরী— তিলোত্তমা ঢাকার একটি সরকারি কোয়ার্টারের ভেতরে এভাবে একজন সরকারি কর্মকর্তার একা একা মরে গিয়ে গলিত লাশ হওয়ার খবরটি খুব বেশি আলোড়ন তোলেনি গণমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ায়। কারণ সবার চোখে এখন করোনাভাইরাস। সব গণমাধ্যমের ক্যামেরা, সোশ্যাল মিডিয়ার সব উদ্বেগ এ ভাইরাস নিয়ে। সেই ডামাডোলে চাপা পড়ে গেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আব্দুল কাদেরের নিঃসঙ্গ মৃত্যুর খবর।
একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, ঢাকার অফিসার্স ক্লাবের বিপরীতে বেইলি স্কয়ার অফিসার্স কোয়ার্টারের একটি বাসার তৃতীয় তলায় একা থাকতেন মি. কাদের। ঘরের কাজের জন্য কোনো গৃহকর্মীও ছিল না। রান্নাবান্নাও নিজেই করতেন। গত ৪ মার্চ বিকেলে বাসার দরজা ভেঙে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
এ ভবনের একজন নিরাপত্তাকর্মী সাংবাদিকদের বলেন, আব্দুল কাদের স্বল্পভাষী মানুষ ছিলেন। আগ বাড়িয়ে কিছু বলতেন না। সালাম দিলে জবাব দিতেন। মাঝে মাঝে তার একজন ছোট ভাই গ্রাম থেকে এসে বাসায় থাকতেন। এছাড়া কারো আনাগোনা ছিল না।
Advertisement
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, পুলিশ দরজা ভেঙে দেখে, নিথর কাদের খাটের একপাশে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। পা ছিল মেঝেতে। পা দুটো পচে ফুলে গিয়েছিল। রস গড়াচ্ছিল মাটিতে। অজস্র মাছি তাকে ঘিরে ছিল। প্রশ্ন হলো, একজন মানুষ এক সপ্তাহ ধরে অফিসে যান না, তার সহকর্মীদেরও কেউ তার খোঁজ নিলেন না?
২.মৃত্যু একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া বা পরিণতি। কিন্তু তারপরও এ নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্যু বিষয়ে পড়ানো হয়। এ বিষয়ে নানা ধরনের গবেষণাও হয়। বলা হয়, মৃত্যু হচ্ছে একগুচ্ছ ধারণা যার কোনো একক সংজ্ঞা নেই। একটা সময় পর্যন্ত মৃত্যুকে সংজ্ঞায়িত বা ব্যাখ্যা করা হতো কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। এখন সেখানে যুক্ত হয়েছে বিজ্ঞান ও যুক্তি। ফলে সংজ্ঞা-ধারণা ও ব্যাখ্যায়ও এসেছে বৈচিত্র্য। তবে এই আলোচনায় মৃত্যুর সংজ্ঞায়ন আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা বরং আব্দুল কাদের নামে একজন সরকারি কর্মকর্তার নিঃসঙ্গ মৃত্যুর বিষয়টিকে নিয়ে এগোতে পারি।
এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের অনেক সূচকে বহুগুণ এগিয়ে থাকা অনেক রাষ্ট্রের চেয়েও বাংলাদেশের পারিবারিক বন্ধন অনেক মজবুত। প্রতি বছরের দুই ঈদে প্রিয়জনের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করতে এই মহানগরী অর্থাৎ রাজধানী ঢাকা ছেড়ে লাখ লাখ মানুষ যেভাবে ছোটে, যেভাবে তাদের হাসিমুখের আড়ালে পথের দুর্ভোগ ও ক্লান্তি যেভাবে ঢাকা পড়ে যায়—তা বিশ্বের যেকোনো দেশেই বিরল ঘটনা। দলে দলে মানুষের এ ছুটে যাওয়াই প্রমাণ করে বাংলাদেশের মানুষ কতটা পরিবার অন্তঃপ্রাণ। সেরকম একটি দেশে একজন উচ্চশিক্ষিত সরকারি কর্মকর্তা বাসার ভেতরে একা একা মরে পড়ে থাকবেন—এটি খুব স্বাভাবিক ঘটনা নয়।
যদিও জাপানে এটিই স্বাভাবিক। কারণ সে দেশের পারিবারিক বন্ধন বাংলাদেশের মতো শক্তিশালী নয়। পক্ষান্তরে সেখানে মানুষের গড় আয়ু অনেক বেশি। জাপানিদের রোগশোকও তুলনামূলক কম হয়। কিন্তু রোগশোক যতই কম থাকুক, বার্ধক্যের চেয়ে বড় অসুখ তো আর হয় না। সুতরাং একজন মানুষ সর্বোচ্চ কত বছর সুস্থ থাকবেন? ৭০-৮০ বছর হয়ে গেলে প্রকৃতি ও শারীরিক নিয়মেই তার শরীরের অনেক কোষ মরে যেতে থাকে। তিনি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েন। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের মতো বৃদ্ধ বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে সন্তানদের একসাথে থাকার প্রবণতা তাদের নেই, সে কারণে জাপানিদের বার্ধক্য হয় নিঃসঙ্গ।
Advertisement
অবসরে যাওয়ার পরে তারা বাসার ভেতরে একা একাই সময় কাটান। সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়ার শারীরিক সক্ষমতাও ধীরে ধীরে কমতে থাকে। শোনা যায়, সেখানে এমন অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যারা মানুষের একধরনের মৃত্যুবীমা করে। অর্থাৎ বাসার ভেতরে কেউ কেউ এরকম একা একা মরে গেলে ওই সংগঠন গিয়ে তার সৎকারের ব্যবস্থা করে।
এরকম একটি সংবাদ হয়তো আপনারও নজরে পড়েছে যে, জাপানে দৈনিক মাত্র ৬০০ টাকা ভাড়ায় ঘরের সব কাজকর্ম করার পাশাপাশি ওই গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে হবে—এমন চাকরিও রয়েছে। এজন্য ‘ওশান রেন্টাল’ নামে একটি অনলাইন সেবা সংস্থাও চালু হয়েছে। মূলত নিঃসঙ্গ মানুষদের সেবা দেয়াই এদের কাজ। ঘরসংসারের কাজ করা থেকে শুরু করে তাদের সঙ্গে সময় কাটানো, সবই করে ওই সংস্থা। জাপানে বসবাসকারীদের কেউ ‘ওশান রেন্টাল’-এর সেবা গ্রহণ করতে চাইলে ওই সংস্থা থেকে পৌঁছে যাবেন একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। যিনি মন দিয়ে কথা শুনবেন। ঘরের যাবতীয় কাজকর্ম করে দেবেন। এমনকি, সমস্যার সমাধানে পরামর্শও দেবেন। একেবারে আপনজনের মতো।
প্রবীণ ও নিঃসঙ্গ মানুষদের সেবায় বাংলাদেশেও উইলিয়াম বেভারেজ ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। রাজধানীর ইস্কাটনে এর অফিস। দেশের একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদের কথা জানি, যার বাসায় প্রতিদিন সকালে এই প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী গিয়ে তার যাবতীয় কাজকর্ম করে দিয়ে আসেন।
আরেকটি খবরও গণমাধ্যমে এসেছে যে, জাপানে নিঃসঙ্গ যুবকদের একাকিত্ব কাটাতে ‘ভার্চুয়াল স্ত্রী’ নামে একটি নতুন ধারণার উদ্ভব হয়েছে। দেশটির প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ভিনক্লু নতুন একটি গ্যাজেট বাজারে এনেছে, যা একইসঙ্গে স্মার্ট হোম ডিভাইস এবং একাকী যুবকদের সঙ্গী হিসেবে কাজ করবে। অভিনব এই গ্যাজেটটির নাম দেয়া হয়েছে ‘গেটবক্স’। গেটবক্স তৈরির মূল লক্ষ্য জাপানি অবিবাহিত তরুণরা।
ওই সংবাদে বলা হয়, দেশটির তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্ব একটি বড় সমস্যা। এর ফলে এদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও আশঙ্কাজনক। তাই তাদের একাকিত্ব কিছুটা হলেও দূর করার জন্য এই কৃত্রিম জীবনসঙ্গীর ডিজাইন করা হয়েছে।
এই ভার্চুয়াল স্ত্রীর নাম হচ্ছে ‘হিকারি’। তাকে দেখা যাবে হলোগ্রাফিক পর্দায়। তিনি স্বামীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবেন, ‘গুড মর্নিং’ বলবেন। জানিয়ে দেবেন আজকের আবহাওয়া কেমন। স্মার্ট হোম ডিভাইসের মতো হিকারি ঘরের বাতি জ্বালাবেন ও নেভাবেন। প্রয়োজনে এসি চালু ও বন্ধ করবেন। স্বামীকে অফিস যাওয়ার আগে বিদায়ও জানাবেন তিনি।
পশ্চিমা সমাজে নিঃসঙ্গতা বা একাকীত্ববোধ কত বড় সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে, তার প্রমাণ মেলে যুক্তরাজ্যে নিঃসঙ্গতা বিষয়ক একজন মন্ত্রী নিয়োগের ঘটনায়। ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, নিঃসঙ্গতা ও সামাজিকভাবে লোকজনের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রথমবারের মতো একজন মন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছে যুক্তরাজ্য। নতুন দায়িত্ব পাওয়া মন্ত্রী ট্রেসি ক্রউচ এর আগে ক্রীড়া ও সুশীল সমাজ বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
সুতরাং আব্দুল কাদেরের মৃত্যুটি আপাতদৃষ্টিতে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও এটি নিয়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে এটি জানা খুবই প্রয়োজন যে, তিনি কেন বাসায় একা থাকতেন; নিকটাত্মীয়দের মধ্যে কারা আছেন, তাদের সাথে তার সম্পর্ক কেমন ছিল; তিনি কি বিবাহিত ছিলেন? যদি তাই হয়, তাহলে তিনি কেন একা থাকতেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা গেলে এটি বাংলাদেশের পরিবার ও সামাজিক গবেষণার একটি কেসস্টাডি হতে পারে। কারণ আড়ালে আবডালে এরকম আরও কত মানুষ নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করছেন এবং তাদের পরিণতি কী হবে—তা নিয়ে ভাবা দরকার।
এই মৃত্যুটি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা আট বছর আগের দিনের সেই বিপন্ন বিস্ময়ে আক্রান্ত নায়কের মতো নয় যার ‘বধূ শুয়েছিলো পাশে— শিশুটিও ছিলো; প্রেম ছিলো, আশা ছিল’— জ্যোৎস্নায় তবু সে কোনো এক ভূত দেখে অশ্বত্থের কাছে এক গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলো তবু একা-একা। কারণ কবিতার নায়কের ভেতরে এক আত্মঘাতী ক্লান্তি ছিল। লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নেই। কিন্তু আমরা কি কোনোদিন জানতে পারব আব্দুল কাদেরের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে কোনো বিপন্ন বিস্ময় ছিল কি না বা বছরের পর বছর তিনি কোনো আত্মঘাতী ক্লান্তি বয়ে বেড়াচ্ছিলেন কি না?
পুলিশ বলছে, ময়নাতদন্তের পরে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে। হ্যাঁ, ওটুকুই জানা যাবে, তার কীভাবে মৃত্যু হয়েছে। যেহেতু ভেতর থেকে দরজা বন্ধ ছিল, অতএব প্রাথমিকভাবে এটা ধরেই নেয়া যায় যে তার হয়তো তার হৃদযন্ত্র আক্রান্ত হয়েছিল, হয়তো মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছিল অথবা তিনি আত্মহত্যা করেছেন কি না, সেটিও হয়তো জানা যাবে। কিন্তু তার বুকের ভেতরে কী কষ্ট ছিল, কেন তিনি ভিড় এড়িয়ে চলতেন, কেন তিনি কম কথা বলতেন, কেন তিনি একাকী জীবন বেছে নিয়েছিলেন—সেই প্রশ্নের উত্তর কি আমরা কোনোদিন জানব?
লেখক : কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন।
এইচআর/এমএস