আর মাত্র ক’দিন পরে যথাযথ মর্যাদায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ পালন করা হবে। বাঙালি জাতির আরাধ্য পুরুষের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ নানা স্বপ্ন দেখছে। এই মাহেন্দ্রক্ষণটি বাঙালির জন্য অবশ্যই নতুন আশা ও স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়ে যাবে। অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষের মতো সাংবাদিক সমাজও এই অনন্য এই ক্ষণের প্রহর গুণছে।
Advertisement
মুজিববর্ষ আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়োজন। এর মাধ্যমে বাঙালি জাতি শুধু যে বঙ্গবন্ধুকে জানবে তা নয়, একইসঙ্গে বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও অর্জনের ধারাক্রম সম্পর্কেও সুষ্পষ্ট ধারণা পাবে। বাঙালির অনন্য এই আয়োজনকে সামনে রেখে এরই মাঝে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপের ঘোষণা পাওয়া গেছে সরকারের পক্ষ থেকে। সেই ধারাবাহিকতায় দেশের সাংবাদিক সমাজও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছ থেকে উপহার প্রত্যাশায় প্রহর গুণছে।
কভিড করোনাভাইরাস বা নোবেল করোনা ভাইরাসের জন্য মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান সীমিত করা হলেও বাঙালিরা বিনম্র চিত্তে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করবে। প্রণতি জানাবে মহাত্মা বঙ্গবন্ধুর প্রতি যিনি নিজের জীবন তুচ্ছ করে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করে গেছেন, দেশ ও জনগণের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় কোনো আপস করেননি। বাঙালি জাতীয় জীবনে ও হৃদয়মানসে বঙ্গবন্ধু একক এবং অকৃত্রিম নেতা হয়ে বসবাস করছেন।
একসময় বঙ্গবন্ধুকে আড়াল করার জন্য, তাঁর মাহাত্ম গোপন করার জন্য বা নামটি ইতিহাস থেকে ছেঁটে ফেলার জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কম চেষ্টা করেননি। আজ পরিস্থিতি ভিন্ন। বাঙালিরা এখন অন্ততঃ উপলব্ধি করতে পারে বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে তারা মাথা তুলে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারতো না। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব পেতো না হাজার বছর নির্যাতিত বাঙালি সমাজ। একথা সবাই উপলব্ধি করতে পারে যে, সততা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ও ধারাবাহিক ত্যাগের কারণে বঙ্গবন্ধু দিনে দিনে চিরভাস্বর হয়েছেন।
Advertisement
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সাংবাদিক সমাজের প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল ছিলেন। জীবদ্দশায় নানা পর্যায়ের সাংবাদিকদের তিনি আগলে রাখতেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু আইনের মাধ্যমে সাংবাদিক সমাজের রুটি-রুজি ও মর্যাদার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। তাঁর সরকার প্রণীত ‘নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কণ্ডিশন্স অ্যান্ড সার্ভিস) অ্যাক্ট ১৯৭৪, সাংবাদিকদের মর্যাদাসম্পন্ন করেছিল। সাংবাদিকরা পেশাজীবী হলেও বৃদ্ধিভিত্তিক পেশায় নিয়োজিত বলে বঙ্গবন্ধু তাদেরকে আলাদাভাবে বিবেচনা করেছিলেন।
পিতার মতো করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সাংবাদিকদের যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। সাংবাদিকদের সমস্যা-সঙ্কটে সহযোগিতার জন্য তিনি সাংবাদিক কল্যাণ তহবিলকে ট্রাস্টে রূপান্তরিত করে আইনি কাঠামো দেন। শুধু তাই নয়, এই ট্রাস্টে থাকা ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা সিড মানিও তিনি অনুদান হিসেবে সরকারী কোষাগার থেকে এবং অন্যদের কাছে থেকে সংগ্রহ করে দিয়েছেন। তাঁর নিজস্ব চিন্তায় গঠিত সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট আজ সাংবাদিকদের আস্থার ঠিকানা। সাংবাদিকদের জন্য যৌথ আবাসন ব্যবস্থা করতে না পারলেও বহু সাংবাদিক শেখ হাসিনার বদান্যতায় আবাসন পেয়েছেন। এজন্য সাংবাদিক সমাজ শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ।
তবে কিছু অপ্রাপ্তি এখনো সাংবাদিক সমাজের মধ্যে রয়ে গেছে। রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের বিকাশে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঠিক ধারা রক্ষায় নিবেদিত সাংবাদিক সমাজ পেশাগত জীবনে নানা সমস্যা-সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েও দেশপ্রেমে অবিচল থেকে কাজ করে। এই অপ্রাপ্তির হতাশা থেকে সাংবাদিক সমাজকে মুক্ত করার সক্ষমতা একমাত্র শেখ হাসিনাই রাখেন বলে মনে করে সবাই। মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে সাংবাদিকদের সেই অপ্রাপ্তি ও হতাশার ইতি ঘটবে বলে সবার বিশ্বাস। সংবাদপত্রে কর্মরত সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারিদের জন্য নবম ওয়েজ বোর্ড ঘোষণা করা হলেও তাতে কিছুটা আশাভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে। আগের ওয়েজ বোর্ডগুলোতে সাংবাদিকদের বছরে দু’টো গ্র্যাচুইটি নির্ধারিত থাকলেও নবম ওয়েজবোর্ড সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি একটি গ্র্যাচুইটির সুপারিশ করে। একইসঙ্গে সংবাদপত্রে কর্মরত সাংবাদিক-কর্মচারিদের আয়কর মালিক কর্তৃক পরিশোধের কথা থাকলেও মন্ত্রিসভা কমিটি আয়কর নিজ নিজ আয় থেকে প্রদানের সুপারিশ করেছে। অথচ নবম ওয়েজ বোর্ড দু’টি ক্ষেত্রেই আগের সুবিধা বহাল রেখেছিল। দীর্ঘদিন থেকে পেয়ে আসা সুবিধা সাধারণত বাড়ে। কিন্তু মন্ত্রিসভা কমিটি সে সুবিধা কমানোর সুপারিশ দিয়ে সাংবাদিক সমাজকে হতাশ করেছে।
এছাড়া একাধিক ওয়েজ বোর্ড থেকে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য (টিভি চ্যানেল ও অনলাইন) আলাদা ওয়েজ বোর্ড গঠনের সুপারিশ করা হলেও বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকে ঝুলে আছে। এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ আমরা সরকার পক্ষ থেকে দেখছিনা। এখন বলা হচ্ছে গণমাধ্যমকর্মী আইন পাস হলে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ওয়েজ বোর্ড বা বেতন কাঠামোর সুরাহা হয়ে যাবে। অথচ কয়েক বছর ধরে গণমাধ্যমকর্মী আইন আটকে আছে। গণমাধ্যমকর্মী আইন পাস হোক বা না হোক ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারিরা তাকিয়ে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দিকে। তাঁর বদান্যতায় বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিকাশ ঘটেছে। তাঁর হাত ধরে জন্ম নেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরতদের সুবিধাদির দায়িত্ব তিনি নিলে সংশ্লিষ্টদের আনন্দের সীমা-পরিসীমা থাকবে না।
Advertisement
সাংবাদিকদের মধ্যে প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো স্থায়ী আবাসন নেই। মিরপুরে সাংবাদিক আবাসিক এলাকা থাকলেও সেখানে সাংবাদিকদের সবার আবাসন সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নানাভাবে নিজেদের বর্তমানকে ঘিরে ভবিষ্যতের পথ তৈরি করার সুযোগ পেলেও প্রকৃত সাংবাদিকরা সে সুযোগ পান না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বদান্যতায় অসহায়-অস্বচ্ছল-আহত সাংবাদিকগণ এবং প্রয়াত বা নিহত সাংবাদিকদের পরিবার গত কয়েক বছর আর্থিক সহায়তা পাচ্ছেন। কিন্তু তাদের মাথা গোঁজার মতো ঠাঁই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছ থেকে পেলে সাংবাদিক সমাজ চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। তাদের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক পল্লী’ নামে একটি আবাসন ব্যবস্থা করা যায় কিনা ভেবে দেখতে পারেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু কন্যা ইচ্ছা করলেই ‘বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক পল্লী’ নামে একটি আবাসিক এলাকা তৈরি করে দিতে পারেন প্রকৃত পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য।
এসব বিষয়ে প্রিয় নেতা মাতৃসম শেখ হাসিনার সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছি। রাষ্ট্র কর্তৃক প্রকৃত ও পেশাদার সাংবাদিকদের পেনশনের বিষয়টিও তাঁর বরাবরে উপস্থাপন করেছি। একজন প্রকৃত সাংবাদিক দেশ-মানুষ ও পেশার প্রতি নিবেদিত থেকে সারাজীবন তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সাংবাদিকতা হলো একটি সার্বক্ষণিক পেশা। অন্যান্য পেশার মতো বেতন-ভাতার নিশ্চয়তা বা চাকরি শেষে বড় অংকের সুবিধাদির পাবার সুযোগ এই পেশায় তেমনভাবে নেই। বুদ্ধিবৃত্তিক পেশা বলে এখানে ফাঁকি দেয়ার সুযোগও কম। সে কারণে সাংবাদিক সমাজের প্রতি রাষ্ট্রের কিছু দায়বদ্ধতা থাকা জরুরি। এরই অংশ হিসেবে সাংবাদিক সমাজের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা করতে পারে রাষ্ট্র। আর এই ব্যবস্থার ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণের সাহসী নেতা শেখ হাসিনা ছাড়া আর কে আছে?
মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশপ্রেমিক সাংবাদিক সমাজকে উপহার হিসেবে নবম ওয়েজ বোর্ড পুনর্বিবেচনা করতে পারেন। তিনিই পারেন আগের মতো দু’টি গ্র্যাচুইটি ও মালিক পক্ষকে আয়কর প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে। শেখ হাসিনা চাইলেই দ্রুততার সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মী আইন পাস ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য স্বতন্ত্র ওয়েজ বোর্ড গঠন হয়ে যেতে পারে। ‘বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক পল্লী’র মাধ্যমে সাংবাদিকদের আবাসন ব্যবস্থা ও পেনশনের সিদ্ধান্তও সহজেই নিতে পারেন মানবতার মা খ্যাত শেখ হাসিনা। সাংবাদিক সমাজ অধীর আগ্রহে প্রিয় নেতা শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
লেখক : বিশেষ সংবাদদাতা, দৈনিক যায়যায়দিন, সদ্য বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।
এইচআর/এমকেএইচ