বৈশ্বিক মহামারি নভেল করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো। এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে বিশ্ববাসীর জীবনযাপনেও। চীনের পর ইউরোপ-আমেরিকার জনজীবনে ‘ভীতি’ নামিয়েছে এই ভাইরাস। সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র, ইতালিসহ পশ্চিমা অনেক দেশেই কোয়ারেন্টাইনে যেতে হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। এই কোয়ারেন্টাইনে থাকা লোকজনের কেমন খাবার-দাবার দরকার, কোন কোন খাবার তাদের সুস্থ ও সবল থাকতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরও কার্যকর করবে- এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন তিন মার্কিন পুষ্টিবিশেষজ্ঞ ক্যারোলাইন ওয়েস্ট পাসেরেলো, বনি টব-ডিক্স ও ব্রিগিটে জেটলিন। তা তুলে ধরা হচ্ছে পাঠকদের জন্য।
Advertisement
তার আগে স্বাস্থ্য সচেতন পাঠকদের একটি গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য জেনে রাখা দরকার। ইনসাইডার ডাটা নামে একটি সংস্থার ওই গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আপাতত কোনো কারণ না থাকলেও এটি ছড়ানোর ধরন দেখে উদ্বিগ্ন মার্কিনিদের ২২ শতাংশই কোয়ারেন্টাইনে যাওয়ার প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছেন। সেজন্য তারা জমিয়ে রাখছেন প্রয়োজনীয় খাবার-দাবার। অর্থাৎ পাশের কেউ একজন করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হলে নিজেকেও কোয়ারেন্টাইনে (উপসর্গ দেখা না দিলেও আলাদা বসবাস) যেতে হবে- এমনটি মাথায় রাখছেন তারা এবং সেজন্য সংকটকালীন খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করে রাখছেন।
পুরনো-বাসি খাবার সরিয়ে স্বাস্থ্যকর প্রয়োজনীয় খাবার জমানযুক্তরাষ্ট্রের নিবন্ধিত ডায়েটিশিয়ান ও পুষ্টিবিদ বনি টব-ডিক্স বলেন, যখন কোনো বিশেষ পরিস্থিতির মুখে পড়ছেন বলে আভাস পাচ্ছেন, তখন দুই সপ্তাহেরও বেশি সময়ের জন্য খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ ওই সময় বাইরে গিয়ে বাড়তি দামে খাবার কিনতে হবে, অথবা খাবার না-ও মিলতে পারে, এমন এক ধরনের শঙ্কায় অনেকের স্নায়ু আরও দুর্বল হয়ে যেতে পারে। অথচ এই সময়টাই মানসিকভাবে শক্ত থাকা দরকার। কিছু খাবার জমা রাখার ফলে মন এই বলে প্রশান্তি পাবে যে, বিশেষ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি আছে।
আরেক নিবন্ধিত ডায়েটিশিয়ান ও পুষ্টিবিদ ব্রিগিটে জেটলিন বলেন, আপনি যদি কোয়ারেন্টাইন পরিস্থিতিতে পড়ার মুখে থাকেন, তবে প্রথম কাজ হবে ঘরের ফ্রিজে বা এ জাতীয় পাত্রে কী কী আছে তা দেখা এবং এর মধ্যে অপ্রয়োজনীয় জিনিস সরিয়ে ফেলা। মেয়াদোত্তীর্ণ জিনিস ফেলে দিতে হবে এবং সংকটকালে সত্যিকারার্থেই কী লাগবে তার জন্য জায়গা খালি রাখতে হবে।
Advertisement
আর স্বাস্থ্যকর খাবারের একটি তালিকা করতে হবে। যেখানে প্রোটিনসমৃদধ মাছ ও মটরশুটি, সবজি ও ফল, টমেটো, রুটি, ভাত, ছোলা, স্বাস্থ্যকর চর্বিসমৃদ্ধ অলিভ অয়েল, বাদাম ইত্যাদি থাকবে। খাবার যখন জমা করছেন, তখন নিজের কিছু পছন্দের রেসিপিও টুকে রাখুন। পাশাপাশি প্রয়োজনের কিছু বাড়তি খাবারও রাখতে হবে। তবে জমা রাখার ব্যাপারটা যেন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে না যায়, অর্থাৎবাড়তি মজুদ যেন না হয়।
আগে রাখবেন তাজা খাবারজেটলিনসহ পুষ্টিবিদদের পরামর্শ, কোয়ারেন্টাইনে হিমায়িত ও সংরক্ষণ উপযোগী খাবারের আগে নিতে হবে তাজা খাবার। যদিও কোনো ফল কোনো রোগ বা অসুস্থতা ঠেকাতে বা সারাতে পারে বলে কোনো প্রমাণ নেই, তবে ফল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে, তা বলা যায়। সেজন্য তাজা ফলমূল রাখতে হবে জমানো খাবারে। আলু, মিষ্টি আলু, পেঁয়াজ এবং লেবুও এক্ষেত্রে বেশ উপকারী।
অনেক বেশি সোডিয়াম-সমৃদ্ধ খাবার ছাড়ুন জেইটলিনের ভাষ্যে, অনেক বেশি সোডিয়াম-সমৃদ্ধ খাবার পানিশূন্যতা তৈরি করে। যার ফলে মাথা ঘোরায়, অবসাদ কাজ করে এবং বিরক্তির তৈরি করে। তাই কম সোডিয়াম-সমৃদ্ধ খাবার বেছে নেয়া যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষ যা খায়, তার মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি সোডিয়াম আসে রেস্তোরাঁর খাবার এবং ক্যানে থাকা স্যুপ ও হিমায়িত খাবার থেকে। কারণ খাবার সংরক্ষণ এবং এর ফ্লেভার বাড়াতে খাবার প্রস্তুতকারকরা সোডিয়াম ব্যবহার করে থাকে। প্রায় ১৫ শতাংশ সোডিয়াম আসে প্রাকৃতিক খাবার থেকে। তাই কোয়ারেন্টাইনে সোডিয়াম-সমৃদ্ধ খাবারগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। খাবারের ফ্লেভারের জন্য লবণের বিকল্প হিসেবে পুদিনা পাতা বা এ-জাতীয় লতাপাতা এবং মরিচ, মরিচের গুঁড়ো ও হলুদের মতো মসলা ব্যবহার করা যেতে পারে।
ভুলবেন না পানিসুস্থতা-অসুস্থতা- সবসময়ই প্রচুর পানি পান করতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। সুতরাং কোয়ারেন্টাইনের মতো বিপদের মুহূর্তে পানি ছাড়া দিনাতিপাত ভাবাই যায় না। অনেকের মতে, প্রত্যেক ব্যক্তির প্রত্যহ পৌনে চার লিটার করে পানি পান করা দরকার। এছাড়া ক্যালোরির জন্য কিছু কোমল পানীয় রাখতে হবে জমানো খাবারের তালিকায়। যদিও কোয়ারেন্টাইনে থাকলে পানি সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার কথা নয়। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে এক্ষেত্রেও সমস্যায় পড়তে হতে পারে। তাই সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
Advertisement
পছন্দের খাবারগুলো অগ্রাধিকার দিনযখন খাবার জমা করছেন, তখন আপনি ও আপনার পরিবারের লোকজন আসলে কী খেতে পছন্দ করে, তেমন খাবারকে অগ্রাধিকার দিন। যা তৈরি করতে সময় লাগবে, তেমন খাবারি এড়িয়ে চলাই ভালো। কারণ অসুস্থতার দিনে আপনি রান্না করার শক্তিও হয়তো পাবেন না। এর পাশাপাশি রান্না বা খাবার তৈরির সামগ্রী রেখে দিতে ভুলবেন না।
সবিশেষ পরামর্শ থাকবে, কোয়ারেন্টাইনের সময়ের জন্য খাবার জমানো লাগবে, এমন কোনো হুজুগ বা গুজব যেন না ছড়ায়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। সাধারণত কেউ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তখন তার সঙ্গে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে যারা মিশেছেন, তাদেরই কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। একেবারে সমানে সবার কোয়ারেন্টাইন প্রয়োজন হয় না। তবে করোনাভাইরাস ব্যাপক আকারে ছড়িয়েছে, এমন কোনো দেশ বা অঞ্চল থেকে ফেরা লোকজনকেও সেল্ফ-কোয়ারেন্টাইনে (স্বেচ্ছায় আলাদাভাবে বসবাস) থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। এক্ষেত্রে স্থানীয় চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের পরামর্শ মেনে চলা আবশ্যক।
এইচএ/জেআইএম