চীন থেকে একটি ভয়াবহ এবং রহস্যময় ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে সারাবিশ্বে। এরকম গল্প নিয়েই ২০১১ সালে মুক্তি পেয়েছিলো হলিউডের সিনেমা ‘কনটেজিয়ন’। সেই সিনেমা তেমন করে বলার মতো ব্যবসা সফল হয়নি। তবে ২০২০ সালে এসে ছবিটির বিষয়বস্তু হয়ে গেল ‘সুপারহিট’।
Advertisement
২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রটির গল্প আর ২০২০ সালের বাস্তবতার সঙ্গে অবিশ্বাস্য মিল দেখা গেছে। বিবিস বাংলার একটি ফিচারে এমন তথ্যই দাবি করা হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, নয় বছর আগেই ‘কনটেজিয়ন’ সিনেমায় করোনাভাইরাসের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিলো। এটাও বলা হয়েছিলো যে ভাইরাসটি ছড়াবে চীন থেকে। বাস্তবেও সেটাই হলো। চীনের একটি প্রদেশ থেকেই বিশ্বজুড়ে মহামারী হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা।
যদিও বেশ কয়েকজন তারকাকে নিয়ে ‘কনটেজিয়ন’ চলচ্চিত্রটি তৈরি হয়েছিল তবুও সেটি ওই বছরের ব্যবসায়ের দিক থেকে ৬১তম হয়েছিল। ছবিটিতে অভিনয়শিল্পী হিসেবে ছিলেন কেট উইনস্লেট, ম্যাট ডেমন, গিনেথ প্যালট্রো, জুডি ল এবং মাইকেল ডগলাসের মতো তারকারা।
Advertisement
নয় বছর পর সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফিরে এসেছে 'কনটেজিয়ন'। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপল আইটিউন স্টোরে সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হওয়া ছবির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে চলচ্চিত্রটি। সেই সঙ্গে গুগল সার্চের তালিকায় শীর্ষে চলচ্চিত্রটির নাম খোঁজার প্রবণতাও বাড়ছে।
‘কনটেজিয়ন’ চলচ্চিত্রটি তৈরি করেছে ওয়ার্নার ব্রাদারস। তারা বলেছে, চীনে যখন প্রথম করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, তখন বিশ্বের জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের তালিকায় এটির অবস্থান ছিল ২৭০তম। কিন্তু তিন মাস পরে, ছবিটি জায়গা করে নিয়েছে নবম অবস্থানে। তার সামনে রয়েছে শুধুমাত্র হ্যারি পটার সিরিজের আটটি চলচ্চিত্র।
এর একমাত্র কারণ হলো করোনাভাইরাস। প্রায় এক দশক আগে তৈরি চলচ্চিত্রটির কাহিনীর সঙ্গে বর্তমান করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের অনেক মিল রয়েছে।
বিবিসি ভাইরাসের ফিচারে এসেছে, ‘টাইটানিক’খ্যাত অভিনেত্রী কেট উইনস্লেট অভিনীত সেই ছবিটিতে দেখানো হয়েছে একজন নারী ব্যবসায়ী (গিনেথ প্যালট্রো অভিনয় করেছেন) একটি রহস্যময় এবং মারাত্মক ভাইরাসে মারা যান। চীনে একটি সফরের সময় তিনি ওই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময় পর্যন্ত ওই ভাইরাসের ব্যাপারে কোনো সতর্কতা জারি করা হয়নি। পরে সেটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
Advertisement
কনটেজিয়নের দর্শকরা বলছেন, বর্তমান বাস্তব জীবনের ভাইরাস সংক্রমণ যেমন চীন থেকে শুরু হয়েছিল, তেমনি চলচ্চিত্রটির এরকম কাহিনীর মিলের কারণেই সেটির জনপ্রিয়তা বেড়েছে।
সেই আগ্রহ আরও বেড়েছে গিনেথ প্যালট্রোর একটি ইন্সটাগ্রাম পোস্টের কারণে। গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেয়ার সময় বিমানে বসে তিনি মুখে মাস্ক পরা এটি ছবি পোস্ট করেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘আমি এই চলচ্চিত্রটিতে আছি। নিরাপদ থাকবেন। করমর্দন করবেন না। নিয়মিত হাত ধোবেন।’
ছবিটিতে প্যালট্রো অভিনীত চরিত্রটি এমইভি-ওয়ান নামের একটি ভাইরাসে আক্রান্ত হয় হংকংয়ের একজন বাবুর্চির সঙ্গে করমর্দনের মাধ্যমে, যিনি একটি শুকর জবাই করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ওই শুকরটি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল বাদুরের মাধ্যমে।
এরপর দেশে ফিরে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, কিছুদিন পরে মারা যান। এরপরে তার ছেলেরও একই রোগে মৃত্যু হয়। কিন্তু তার স্বামী, ম্যাট ডেমনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভাইরাসটি আক্রমণ করতে পারেনি। বাস্তবে, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন যে, গত ডিসেম্বর মাস নাগাদ চীনের উহান শহরে পশু থেকে মানব শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাসটি ছড়াতে শুরু করে।
এটাও ধারণা করা হয় যে, করোনাভাইরাস বাদুরের মাধ্যমে বিস্তার ঘটেছে, যেমনটা ঘটেছিল সার্স মহামারির ক্ষেত্রে ২০০২-২০০৩ সালে। বাদুর থেকে সেটা অন্য একটি প্রাণি হয়ে মানব শরীরে আসে।
অন্য কোন প্রাণি থেকে করোনাভাইরাস এসেছে, সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে চীনের কর্তৃপক্ষ উহান শহরের একটি পশুপাখির বাজারকে ভাইরাসের কেন্দ্রস্থল বলে শনাক্ত করেছে।
যেভাবে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে, চলচ্চিত্রের কল্পিত ভাইরাসটিও একে অপরকে স্পর্শের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
তবে সিনেমার কল্পিত ভাইরাসের চেয়ে অবশ্য বাস্তব ভাইরাস কম প্রাণঘাতী। চলচ্চিত্রে মৃত্যুহার বলা হয় ২৫%, তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে মৃত্যুহার ৩.৪%। কনটেজিয়ন চলচ্চিত্রে এমইভি-ওয়ানে আক্রান্ত হয়ে একমাসের মধ্যেই বিশ্বে দুই কোটি ষাট লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। তবে চীনে তিন মাস আগে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটনার পর এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা চার হাজার হয়নি।
আইসোলেশনচলচ্চিত্রে যখন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়, তখন এপিডেমিক ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস (যা বাস্তবের একটি প্রতিষ্ঠান) কর্মীরা সংক্রমিতদের সনাক্ত এবং আইসোলেশন করতে শুরু করেন। ওই চলচ্চিত্রে যুক্তরাষ্ট্রের শহর শিকাগো কোয়ারেন্টিন করা হয়, যার সঙ্গে চীনের এলাকাকে অবরুদ্ধ করে ফেলার তুলনা করা যেতে পারে। কোভিড-১৯ বিস্তার ঠেকাতেও দেশের উত্তরাঞ্চলে অনেকটা একই ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছে ইতালি।
চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকারের ভয়কনটেজিয়নের এই ফিরে আসার ব্যাপারটি অবাক করেছে চিত্রনাট্যকার স্কট যি বার্নসকে। ফরচুন ম্যাগাজিনকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘কনটেজিয়ন চলচ্চিত্রের মূল আইডিয়াটি ছিল এটাই তুলে ধরা যে, এ ধরণের প্রাদুর্ভাবের জন্য আধুনিক সমাজ কতটা নাজুক। কতোটা প্রস্তুতি রয়েছে আমাদের।’ আজ বাস্তবেও কিন্তু সেই প্রশ্নই উঠছে।
বার্নস আরও বলেছেন, ‘কনটেজিয়ন এবং করোনাভাইরাসের মধ্যে যে মিলগুলো দেখা যাচ্ছে, সেটা কাকতালীয়, আসলে এটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, এর ফলে সমাজে কি ঘটছে, ভয় কীভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, তার ফলে কী ঘটছে সেটা।’
ওই ছবিতে জুডি ল অভিনীত চরিত্রটি ভাইরাস নিয়ে নানা গুজব ছড়িয়ে বেড়ান এবং ভাইরাসের একটি জাল ঔষধের প্রচারণা চালান। বাস্তবেও তার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। অনলাইন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান অ্যামাজন সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা দশ লাখের বেশি পণ্যের বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে, কারণ এসব পণ্যের বিক্রেতার দাবি করেছিলেন যে, সেগুলো কোভিড-১৯ সারাতে সহায়তা করে।
সুপরিচিত আমেরিকান টেলিভিশন তারকা জিম বাক্কের নিউইয়র্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছেন, কারণ এক সপ্তাহ আগে তিনি একটি টনিকের প্রচারণায় বলেছিলেন যে, সেটা ভাইরাস থেকে আরোগ্য হতে সাহায্য করে। বর্তমান প্রাদুর্ভাবে এই গুজবও ছড়িয়ে পড়েছে যে, ভাইরাসটি আসলে একটি রাসায়নিক অস্ত্র হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল। এমনকি চিত্রনাট্যকার বার্নসের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, কোনো কোনো ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যমে এসে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে যে, তিনি গোপন সংস্থার সদস্য, যারা বিশ্বের ব্যাপার-স্যাপারগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। যেহেতু ভাইরাসটি নিয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না তাই উদ্বেগের ব্যাপার হলো নানা রকম ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। যা ভাইরাসের মতোই বিপদজনক।
এলএ/এমকেএইচ