বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী কিডনি রোগীর সংখ্যা ৮৫ কোটিরও অধিক। বিশ্বের সর্বমোট জনসংখ্যার অনুপাতে এর প্রকোপ ১১-১৩% (আগস্ট, ২০১৯)। প্রতি বছর ধীর গতিতে কিডনি রোগে মারা যায় ২৪ লাখ মানুষ এবং আকস্মিক কিডনি বিকলে মারা যায় আরো ১৭ লক্ষ মানুষ। দিন দিন কিডনি রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলেছে। আশংকা করা হচ্ছে ২০২০ এর শেষের দিকে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের প্রাদুর্ভাব হবে ১৪.৪% এবং ২০৩০ এ দাঁড়াবে ১৬.৭%। মৃত্যুঘাতী হিসেবে কিডনি রোগের অবস্থান ২ যুগ আগে ছিল ২৭তম, বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৬ষ্ঠ তম এবং ২০৪০ সালে পৌঁছাবে ৫ম অবস্থানে। সামান্য মাত্রার দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের উপস্থিতি কার্ডিওভাসকুলার রোগে মৃত্যুর হার বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়, কমিয়ে দেয় সংক্রামক ব্যাধির প্রতিরোধ ক্ষমতা। তাই কিডনি রোগকে ভয়াবহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
Advertisement
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৫ সালে সারা বিশ্বে ৫ কোটি মৃত্যুর মধ্যে ৩ কোটি মৃত্যু কোন না কোন ভাবে কিডনি রোগ এর সাথে সম্পৃক্ত ছিল। একবার কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে গেলে তার চিকিৎসা ব্যয় এত বেশি যে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মত দেশের ১০ ভাগ কিডনি বিকল রোগী দীর্ঘমেয়াদী এই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে না (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)। বাকি ৯০ ভাগ অর্ধ চিকিৎসা বা বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। এই চিকিৎসা চালাতে গিয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায় কিন্তু পাশাপাশি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সংবাদও আছে। আমরা যদি একটু সচেতন হই, যদি সুস্থ জীবন যাত্রা চর্চা করি এবং যারা কিডনি রোগের ঝুঁকিতে আছেন তারা যদি নিয়মিত কিডনি রোগের স্ক্রিনিং করেন, তাহলে ৪০ থেকে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে এই ভয়াবহ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।এবারের বিশ্ব কিডনি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হল ‘Kidney Health for Everyone Everywhere –from Prevention to Detection and Equitable Access to Care” অর্থাৎ “কিডনি স্বাস্থ্য সবার জন্য সর্বত্র-প্রতিরোধ থেকে সনাক্তকরণ চিকিৎসায় সবার সমান সুযোগ”। এবারের প্রতিপাদ্যে কিডনি রোগ প্রতিরোধের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেই সাথে আরো গুরুত্ব দেয়া হয়েছে প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগ সনাক্ত করে, তার গতি কমিয়ে আনা এবং যাদের কিডনি বিকল হয়ে গেছে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে ধনি-গরীব, স্থান, কাল, পাত্র নির্বিশেষে সবাইকে চিকিৎসার সমান সুযোগ দেয়া ।
কিডনি রোগের প্রার্দুভাব কমানের জন্য ৩ টি পর্যায়ে পদক্ষেপ নেওয়া যায়। যথাঃ-
ক) প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিরোধ : কিডনি আক্রান্ত হওয়ার পর্বেই যে সমস্ত কারণে কিডনি রোগ হয় সেই কারণ গুলোর প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত ওজন, ধূমপান, অলস জীবনযাপন এই সমস্ত কারণে কিডনি রোগের জন্ম হতে পারে।
Advertisement
৮ টি সুস্থ জীবনযাত্রা বা লাইফস্টাইল নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়। এই লাইফস্টাইল গুলো হলো -
১. কায়িক পরিশ্রম, খেলাধুলা ও নিয়মিত ব্যায়াম করা। ২. উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা। ৩. সুপ্ত উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা।৪. স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ যাতে প্রতিদিন শাক-সবজি ও ফল থাকে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।৫. পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা। ৬. ধূমপান থেকে বিরত থাকা।৭. ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন ঔষধ সেবন না করা।৮. নিয়মিত কিডনির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা।
খ) দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রতিরোধ যখন কোনো ব্যক্তি কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে গেছে তখন চিকিৎসার উদ্দেশ্য থাকে, যে কারণে হয়েছে তার চিকিৎসা করা এবং কিডনির ক্ষতি হওয়ার গতি কমিয়ে আনা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিকিৎসার মাধ্যমে কিডনি রোগ নির্মূল করা। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট খাদ্য তালিকা মেনে চলা, উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা, প্রোটিন কমানোর জন্য ARB or ACEI সেবন করা এবং নিয়মিত সুস্থ জীবন যাত্রা মেনে চলা যেমন- ব্যায়াম করা, কম আমিষযুক্ত খাবার খাওয়া, ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখা, ধূমপান পরিত্যাগ করা, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা।
গ) তৃতীয় পর্যায়ে প্রতিরোধ এই ক্ষেত্রে যখন কিডনির কার্যকারিতা শেষ ধাপে পৌঁছে যায় তখন অনেক ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। এই জটিলতা প্রতিরোধ করতে অনেক ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা যায়। আগে থেকেই রোগীকে কিডনি সংযোজন, ডায়ালাইসিস ও এভি-ফিস্টুলা সম্পর্কে ধারণা প্রদান করতে হবে।যাতে করে মারাত্মক জটিলতার আগেই তারা চিকিৎসার আওতায় আসে।
Advertisement
এসব প্রতিরোধমূলক ধাপগুলো আমাদের উন্নয়নশীল দেশে বাস্তবায়িত করতে নিন্মে কিছু সুপারিশ করা হল।
০১. কিডনি রোগের প্রাদুর্ভাব, ভয়াবহতা ও প্রতিরোধ সম্পর্কে দেশের সকল স্তরের মানুষকে সচেতন করা।০২. সকল বিদ্যাপাঠ, কর্মস্থল, শহর ও নগরে সুস্থ জীবনযাত্রা প্রণালীর চর্চার সুযোগ তৈরি করা।০৩. নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও কর্মক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন। ০৪. কিডনি সংযোজন ও ডায়ালাইসিসের সকল ব্যয় সরকারি স্বাস্থ্যবীমার অন্তর্ভুক্ত করা।০৫. ডাক্তার, নার্সসহ সকল স্বাস্থ্য কর্মীদের কিডনি রোগ ও প্রতিরোধ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান।০৬. ধনী-গরীবের মাঝে অর্থনৈতিক ও ক্রয় ক্ষমতার ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে।০৭. মূত্যুর পর অঙ্গদানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে।০৮. কিডনি বিশেষজ্ঞের সংখ্যা বাড়াতে হবে।উপরোক্ত সুপারিশ বাস্তবায়নে দেশের নীতিনির্ধারক, রাজনৈতিক নেতৃবর্গ, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজসেবাকর্মী, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বসহ সর্বস্তরের প্রতিনিধিদের সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।লেখক : এমবিবিএস, এমডি, এফসিপিএস, এফআরসিপি। প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, কিডনি এওয়ারনেস মনিটরিং এন্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস)। অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কিডনি রোগ বিভাগ আনোয়ান খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ।
এইচআর/এমকেএইচ