আন্তর্জাতিক

করোনায় বিপর্যয়ে বিমানখাত, গণমাধ্যমে আতঙ্ক ছড়ানোর অভিযোগ

চীনের উহান থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার যদি অব্যাহত থাকে তাহলে বিশ্বের বিমান পরিবহন সংস্থাগুলোকে ১১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। বিমান সংস্থাগুলোর জোট ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ) এ শঙ্কার কথা জানিয়েছে।

Advertisement

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের সময় বিমান সংস্থাগুলোর যে ক্ষতি হয়েছিল এবারের ক্ষতি হবে তার সমান। আইএটিএ সতর্ক করে বলেছে, যদি শিগগিরই ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা না যায় তাহলে এয়ারলাইন্সগুলো ১৯ শতাংশ ব্যবসা হারাবে।

তবে আইএটিএ সম্প্রতি যে ক্ষতির পরিমাণের কথা জানালো দুই সপ্তাহ আগে তাদেরই দেওয়া পূর্বাভাসের চেয়ে তা তিনগুণেরও বেশি। দুই সপ্তাহ আগে আইএটিএ তাদের পূর্বাভাসে জানিয়েছিল, মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে বিমান সংস্থাগুলোর ক্ষতি হবে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

আইএটিএ-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলেকজান্দ্রি দে জুনিয়াক (সিইও) এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘করোনার কারণে ইভেন্টগুলো বন্ধ হওয়া প্রায় নজিরবিহীন। দুই মাসেরও অল্প সময়ের মধ্যে, বিশ্বের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিমান শিল্পের অবস্থা আরও খারাপের দিকে নাটকীয় মোড় নিয়েছে। এটা এখনো স্পষ্ট নয় যে ভাইরাসটির বিস্তার কতটা হবে, কিন্তু এটা একটা সংকট।’

Advertisement

আইএটিএ বলছে, করোনার কারণে এই ক্ষতির মুখে সবচেয়ে বেশি পড়বে এশিয়া এবং ইউরোপের বিমান পরিবহন সংস্থাগুলো। শুধু এশিয়ার প্যাসিফিক অঞ্চলের বিমান সংস্থাগুলোর এই ক্ষতির পরিমাণ হবে ৫৮ বিলিয়ন। গত বছর বিশ্বের বিমান পরিবহন সংস্থাগুলোর মোট আয় ছিল ৮৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলার।

আইএটিএ-এর প্রধান নির্বাহী আরও বলেন, যদি শিগগিরই প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তাহলে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াবে। একইসঙ্গে বিশ্বের বিমান শিল্পের ক্ষতির পরিমাণ কমে হবে ৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে ছোট বিমান পরিবহন সংস্থাগুলো।

ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং ক্রেতাদের চাহিদা কমে যাওয়ায় বিশ্বের প্রথম সারির কয়েক ডজন বিমান পরিবহন সংস্থা চীনে চলাচলকারী তাদের ফ্লাইট বাতিল করেছে। এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকার বেশ কিছু বিমান সংস্থা তাদের ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে; যার মারাত্মক ও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এই খাতে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, করোনাভাইরাসের ভীতিতে যাত্রীরা ভ্রমণ বাতিল করায় বিমান পরিবহন শিল্পে বিপুল এই লোকসান দেখা যাচ্ছে। ভাইরাসটি বিস্তার লাভের পর থেকে বিভিন্ন শিল্পখাতে লোকসানের আশঙ্কা তৈরি হয়। আইএটিএ-এর নতুন এই মূল্যায়ন এই খাতে লোকসানের ভয়াবহ চিত্র উঠে এল।

Advertisement

তবে বিশ্বব্যাপী বিমান পরিবহন শিল্পের এ বিপর্যয় শুধু করোনার কারণেই নয়। ব্রিটিশ বিমান পরিবহন সংস্থা ফ্লাইবি দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় এ শিল্পের ব্যবসায় তার প্রভাব পড়েছে। এর বাইরে আরও কিছু কোম্পানির ফ্লাইট বাতিল ও বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এই শিল্পখাতে।

গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে আতঙ্ক ছড়ানোর অভিযোগ

চীনের উহান থেকে বিস্তার লাভ করা করোনাভাইরাস এখন বিশ্বের শতাধিক দেশে ছড়িয়েছে। ভাইরাসটির সংক্রমণে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৪ হাজার ২৯২ জনের। এছাড়া আক্রান্তের ঘটনাও ১ লাখ ১৮ হাজার ছুঁই ছুঁই। তবে করোনা আক্রান্ত লক্ষাধিক মানুষের মধ্যে ৬৫ হাজার ৮৯৩ জন সুস্থ হয়েছেন।

চীনের পর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হারের দিক দিয়ে এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে ইউরোপের দেশ ইতালি। এদিকে ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থাও বেশ নাজুক। গোটা পৃথিবীতে মানুষ যেমন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, তেমনি করোনার ছোবল পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতেও।

তবে করোনা নিয়ে গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে আতঙ্ক ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। অনেকে বলছেন, বিদেশি গণমাধ্যম, বিশেষ করে মার্কিন গণমাধ্যমগুলো সারাদিন করোনাভাইরাসকে তাদের প্রধান সংবাদ হিসেবে দেখাচ্ছে। বিশ্বের কোথাও করোনায় মৃত্যুর সংবাদ পেলে সঙ্গে সঙ্গে তা প্রধান সংবাদ হচ্ছে।

কিন্তু মৃতের সংখ্যা বড় করে দেখালেও করোনায় আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন যে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরছে, এই সংবাদটা এসব গণমাধ্যম তাদের প্রধান সংবাদ হিসেবে প্রকাশ করছে না। বিশেষ করে সিএনএন, ওয়াশিংটন পোস্ট ও নিউইয়র্ক টাইমসের মতো মার্কিন গণমাধ্যমগুলো।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার সাড়ে তিন শতাংশের কিছু বেশি। এদিকে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হওয়া মানুষের হার প্রায় ৬০ শতাংশ। আক্রান্তদের অনেকে সুস্থ হচ্ছেন। তবে হাজার হাজার মানুষ করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরলেও এই খবরটা তারা মানুষকে জানাচ্ছে না।

এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কোনো শিশুর মৃত্যুসংবাদ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ করোনায় আক্রান্ত হয়ে ০-৯ বছর বয়সী কারও মৃত্যুর ঘটনা দুনিয়ার কোথাও ঘটেনি। তবে এখন পর্যন্ত ১০-১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে একজনের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া গেছে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের অর্ধেকের বয়স ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে। এছাড়া অবশিষ্ট ৩০ শতাংশের বয়স ৬০-৬৯ এর মধ্যে। অর্থাৎ করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃতদের ৮০ শতাংশের গড় বয়স ৬০-৭০ এর ঊর্ধ্বে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ আগে থেকেই অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত।

অভিযোগ আরও উঠেছে যে, গত বছরই যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ ফ্লুতে বিশ হাজারের মতো মানুষ মারা গেছে। সাধারণ ফ্লু মানে জ্বর, সর্দি-কাশি ইত্যাদিতে। এর প্রতিষেধক আছে অসংখ্য। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত দেশে এত মানুষের মৃত্যু হলেও মার্কিন গণমাধ্যম এটা নিয়ে কোনো হইচই করেনি।

অনেকে আবার এতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের সংশ্লিষ্টতাও দেখছেন। কেউ কেউ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশ। আর চীনের অর্থনীতি দ্বিতীয় বৃহত্তম। অর্থাৎ চীন সম্পর্কে দুনিয়ার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো গেলে তা মার্কিন অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করবে।

এসএ/জেআইএম