মতামত

আতঙ্ক ছড়াবেন না, সতর্ক থাকুন

শঙ্কাটা ছিল অনেকদিন ধরেই। করোনা যেভাবে একের পর এক দেশে ছড়িয়ে পড়ছিল, তারমধ্যে আমাদের আশপাশের দেশগুলোও ছিল; তাতে বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণটা ছিল সময়ের ব্যাপারমাত্র। শঙ্কার আরেকটা কারণ ছিল আমাদের বন্দরগুলো। বিমান, সমুদ্র এবং স্থলবন্দর হয়ে আসা মানুষদের দেশে ঢোকার আগে যথেষ্ট পরীক্ষা করা হচ্ছিল না। পরীক্ষার চেষ্টা হয়নি, তা বলব না; তবে সে চেষ্টাটা যথেষ্ট ছিল না। বিমানবন্দর দিয়ে দেশে আসা অনেকে অভিযোগ করেছেন, তাদের যথাযথ পরীক্ষা করা হয়নি। আক্রান্ত দেশগুলোর সঙ্গে বিমান যোগাযোগ অক্ষুণ্ন ছিল। তাই শঙ্কাটাও বেশি ছিল। করোনা বাংলাদেশে আসবেই, এ ব্যাপারে আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম। করোনা ঠেকাতে হলে যতটা বিচ্ছিন্নতা প্রয়োজন, ততটা আসলে সম্ভব ছিল না কারও পক্ষেই।

Advertisement

তবে আমার ভয়টা ছিল অন্য জায়গায়। করোনা নিয়ে এসে কেউ যদি বিমানবন্দর পার হয়ে বাড়ি চলে যেতে পারেন, তাহলে সেটা করোনার দ্রুত বিস্তার নিশ্চিত করবে। ঘটেছেও তাই, বাংলাদেশে যে তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা গেছে, তাদের দুইজন ইতালি থেকে এসেছেন। অন্যজন তাদের পরিবারের সদস্য। এখন প্রশ্নটা হলো, যদি ইতালি থেকে আসা দুজন বিমানবন্দরেই শনাক্ত হতেন, তাহলে তো তাদের পরিবারের সদস্যরা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকতেন না।

তাই করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর কী কী করা হবে, তার তালিকা না করে, যাতে ছড়াতে না পারে; সেই চেষ্টাটা করা সহজ। আমাদের সবার আগে বন্দরগুলো একশভাগ নিরাপদ করতে হবে। যাতে একজন মানুষও করোনাভাইরাস নিয়ে দেশে ঢুকতে না পারেন। সবগুলো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও স্থলবন্দরেই নিশ্ছিদ্র নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। বন্দরে আটকানোটা যত সহজ, সেখানে কারও চোখ ফাঁকি দিয়ে জনসমুদ্রে মিশে গেলে করোনার বিস্তার ঠেকানো ততটাই কঠিন।

একটা কথা আমাদের সবার মনে রাখা দরকার। বন্দরগুলোতে যতই কড়াকড়ি থাকুক, আমরা কেউ যেন বিরক্ত না হই। কারণ এটা করে হচ্ছে আমাদেরই স্বার্থে। আপনি যদি চালাকি করে বিমানবন্দরে কর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাসায় চলে যান, তাহলে কিন্তু আপনি নিজে তো বটেই, আপনার পরিবারকেও বড় ঝুঁকির মধ্যে নিয়ে গেলেন। ফাঁকি দেয়া তো দূরের কথা বরং, বন্দরে আপনাকে যথাযথ পরীক্ষা করা না হলে, তাদের বাধ্য করুন। তাও করোনা নিয়ে বাসায় যাবেন না।

Advertisement

করোনা সত্যি সত্যি টি-২০ ভাইরাস। গত বছরের শেষ দিকে চীনের উহানেৱ একটি সামুদ্রিক মাছের বাজার থেকে করোনাভাইরাস ছড়ায়। তবে আতঙ্কটা শুরু হয় এ বছরের শুরুতে আর প্রথম মৃত্যুর খবর আসে ১১ জানুয়ারি। ভয়টা হলো দুই মাসের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি দেশে। আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে আগেই। মৃতের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার। শুধু ২০২০ সালে এসেছে বলেই কিন্তু একে টি-২০ ভাইরাস বলা হচ্ছে না। যে দ্রুতগতিতে এটা ছড়াচ্ছে, তাও ক্রিকেটের টি-২০ স্টাইলে।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যত দ্রুত এসেছে, তত দ্রুতই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে ভয়ঙ্কর করোনা। আমার ধারণা এটাও বিশেষজ্ঞদের একটা উইশফুল থিংকিং। কবে যাবে, দ্রুত না আস্তে, আদৌ যাবে নাকি ঘুরে ফিরে আসবে; জানি না। তবে এরইমধ্যে করোনাভাইরাস কাঁপিয়ে দিয়েছে গোটাবিশ্ব। সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি মৃত্যু বা লাখের বেশি আক্রান্ত তো আছেই; করোনা আসলে একইসঙ্গে ধ্বংস করে দিচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতিও। কারণ করোনার শুরুটা বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠা চীন থেকে। তাই এর বাণিজ্যিক প্রভাবটাও হয় বিশাল। এরই মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেয়েছে, যার প্রভাব পড়বে সামনের দিনগুলোতে।

সৌদি আরব সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে ওমরাহ হজ। অনেক দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শপিংমল বন্ধ হয়ে গেছে। পাব, বার, আড্ডার জায়গায়ও লোক কম। লোক সমাগম হতে পারে, এমন সব আয়োজনই বন্ধ করে দিয়েছে অনেক দেশ। পর্যটন ব্যবসা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ভ্রমণ করছেন না। করোনার প্রভাব নিয়ে এই ছোট লেখায় শেষ হবে না। আর করোনা গেলেও এর প্রভাব থাকবে বহু বহুদিন। তাই আপাতত আমরা করোনা প্রতিরোধের ব্যাপারেই নজর দেই।

শুরুতেই বলেছি, করোনা যে বাংলাদেশে আসবেই, সেটা আমি জানতাম। কারণ বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ এবং বাংলাদেশের অনেক মানুষ দেশের বাইরে থাকে। তাই আসা-যাওয়া ঠেকানো কখনোই পুরোপুরি সম্ভব নয়। আর ভয়টা হলো বাংলাদেশ যেমন ঘনবসতির দেশ, তাতে করোনা দ্রুত ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেভাবে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, আমাদের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। যেমন বলা হয়, গণপরিবহন এড়িয়ে চলতে। কিন্তু বাংলাদেশে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সব স্কুল-কলেজ বন্ধ করা বা লোকসমাগম বন্ধ রাখাও সম্ভব নয়। বাজার-হাটও চলবে। এক কারওয়ান বাজারে প্রতিদিন যত লোক আসে, অনেক দেশের জনসংখ্যাও তত নয়। যদি জানতাম, করোনা সাতদিন থাকবে, তাহলে বলতাম, সব বন্ধ করে দিন; সাতদিন ঘরে বসে কাটিয়ে দেব। কিন্তু সেটা যেহেতু সম্ভব নয়। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

Advertisement

প্রথম কথা হলো আমাদের পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। এটা অবশ্য করোনা বলে নয়, পরিচ্ছন্নতাটা আমাদের নিত্যদিনের চর্চা হওয়া উচিত। কিছু ধরা বা খাওয়ার আগে ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে হবে। বাসায় ফেরার পর প্রথম কাজ হলো হাত ধুয়ে ফেলা। চেষ্টা করতে হবে যতটা সম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে চলতে। অপ্রয়োজনে বাসার বাইরে না যাওয়া, স্বল্প দূরত্বে হেঁটে যাওয়াই ভালো। গণপরিবহনে চড়লেও যথাসম্ভব ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে। যেখানে সেখানে হাত দেয়া যাবে না। বাসের হাতল, সিট, সিঁড়ির রেলিং, আপনার নিজের গাড়ির দরজা, লিফটের বাটন, এমনকি ঘরের দরজার হাতল ধরতেও সাবধান। যেকোনো জায়গায় ভাইরাস থাকতে পারে। কোথাও হাত দিতে বাধ্য হলে যত দ্রুত সম্ভব ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। হাত না ধুয়ে এমনকি নিজের মুখ, চোখ, নাক স্পর্শ করা যাবে না। আপনার হাত থেকেই ভাইরাসটি আপনার শরীরে প্রবেশ করতে পারে। বিপদ কিন্তু সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে। টাকা-পয়সা হাতের ময়লা। টাকা ধরলে সেই ময়লা ধুয়ে ফেলুন। সম্ভব হলে কয়েকদিন টাকা এড়িয়ে চলুন। কার্ড মানে প্লাস্টিক মানি থাকলে ব্যবহার করুন। আপনার নিত্যসঙ্গী মোবাইলটিকে পরিচ্ছন্ন রাখুন। সবচেয়ে বড় সতর্কতা হলো হাঁচি-কাশি দেয়া। কোনোভাবেই প্রকাশ্য বাতাসে হাঁচি বা কাশি দেবেন না। রুমাল বা টিস্যু দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে নিন। ব্যবহারের পর টিস্যু যেখানে সেখানে ফেলবেন না। কিছু না থাকলে হাত দিয়ে আড়াল করে হাঁচি বা কাশি দিন। পরে হাত পরিষ্কার করে নেবেন। যেখানে সেখানে কফ বা থুথু ফেলবেন না।

খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। চেষ্টা করতে হবে কাঁচা কিছু না খাওয়ার। খেলেও ভালো করে না ধুয়ে কিছুই খাওয়া যাবে না। সব খাবার ভালো করে সেদ্ধ করে খেতে হবে। অর্ধসেদ্ধ মাছ, মাংস বা ডিম খাওয়া যাবে না। রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে কিছু খাওয়া যাবে না। হাত মেলানো বা বুক মেলানোর সৌজন্যটা আপাতত শিকেয় তুলে রাখুন। মাথা ঝাঁকিয়ে বা কনুই বা মুষ্টি মিলিয়ে আপাতত কাজ সারুন। প্রেম-ট্রেমও কদিন একটু সাবধানে করুন। প্রিয়জনের চুমুও আপনার বিপদের কারণ হতে পারে। তাই সাবধান। আপনি যেন আপনার প্রিয়জনের বিপদের কারণ না হন। যদি আপনার শ্বাস নিতে কষ্ট হয় বা জ্বর-সর্দি-কাশি হয় দ্রুত ডাক্তারের কাছে যান।

এতক্ষণ যেসব সাবধানতা বা পরিচ্ছন্নতার কথা বললাম, তা কিন্তু নতুন কোনো কথা নয়। আমাদের সবসময়ই পরিচ্ছন্ন থাকা উচিত। ইসলাম ধর্মে পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়। মুসলমানরা দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে অজু করলেও অনেকটা নিরাপদ থাকতে পারেন।

আমি অনেককে হাসতে হাসতে বলেছি, আমার বাসায় কখনও করোনা ঢুকতে পারবে না। করোনা ঠেকাতে যা যা সাবধানতার কথা শুনছি, আমার স্ত্রী মুক্তি গত ২৫ বছর ধরে আমাদের ওপর তা প্রয়োগ করছেন। তিনি বাজার থেকে আপেল কিনলেও সেটা পারলে সাবান দিয়ে ধুয়ে নেন। তার এই পরিচ্ছন্নতাবাতিক নিয়ে আমরা সবসময় হাসাহাসি করি। এবার তিনি আমাদের নিয়ে হাসবেন। তবে করোনা হলে সবার আগে আমার হবে। সারাক্ষণ চোখে, নাকে মুখে হাত দেয়ার বদভ্যাস আমার বহু পুরোনো। এবার যদি করোনার ভয়ে এই বদভ্যাসটা দূর হয়।

এতক্ষণ যা বললাম, তার কোনোটাই কিন্তু অসম্ভব নয়, ভয়ঙ্করও নয়। করোনাকে যতটা বিপদজনক হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে, করোনা কিন্তু ততটা নয়। করোনা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার একদম কিছু নেই। প্রথম কথা হলো, করোনার মৃত্যুহার দুই শতাংশের মতো। এরচেয়ে বেশি মৃত্যুহারের অনেক রোগের সাথে আমাদের নিত্য বসবাস। বাংলাদেশের সড়কগুলো বরং করোনার চেয়ে অনেক বেশি বিপদজনক। ঝুঁকিটা যদি আরও ছোট করে আনি, তাহলে দেখা যাবে শিশু, তরুণ, যুবকরা করোনার টার্গেট নয়। করোনায় সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে আছে বয়স্করা। বিশেষ করে যারা আগে থেকেই বক্ষব্যাধি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস বা কিডনির কোনো জটিল অসুখে ভুগছেন; করোনা তাদের জন্য একটু বেশি ঝুঁকির। তাই আপনার পরিবারের প্রবীণ সদস্যের দিকে একটু বাড়তি নজর রাখুন। তাকে চোখে চোখে রাখুন। বাইরে যেতে দেবেন না। ব্যস তাহলেই কিন্তু ঝুকি অনেকটাই কমে গেল।

করোনা মোকাবিলায় সরকার সবধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। যেহেতু এখনও কোনো টিকা বা ওষুধ আবিষ্কার হয়নি, তাই প্রাথমিকভাবে ডাক্তাররা উপসর্গের চিকিৎসা দেবেন। যেহেতু একটু দেরি করে বাংলাদেশে এসেছে, তাই সরকার প্রস্তুতি নেয়ারও সময় পেয়েছে বেশি। একাধিক হাসপাতাল আলাদা করে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। অনেক হাসপাতালে করোনা কর্নার বানানো হয়েছে। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। করোনা নিয়ে আতঙ্কিত হবেন না, গুজব ছড়াবেন না; খালি সতর্ক থাকবেন।

এইচআর/বিএ/পিআর