ধর্ম

নারীর অধিকারে যেসব দিক-নির্দেশনা এসেছে কুরআনে

নারীর জন্য অনেক আনন্দ ও খুশির সুসংবাদ হচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলা নারীর অধিকারে নাজিল করেছেন অনেক আয়াত। যেসব বিষয় নিয়ে নারী নিজেকে নিয়ে আনন্দিত হতে পারে আবার নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করতে পারে।

Advertisement

ইসলামই একমাত্র জীবন ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থা নারীকে অনন্য উচ্চতা ও মর্যাদায় সমাসীন করেছে। আবার নারীর প্রতি বৈরি আচরণে এসেছে কঠোর হুশিয়ারি। ইসলামের মতো নারীর এ মর্যাদা অন্য কোনো ধর্ম-বর্ণ-জাতিগোষ্ঠী দিতে পারেনি।

নারীর অধিকার, সামাজিক মর্যাদা, করণীয়, দাম্পত্য জীবন ও সংসার সবই বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কুরআনে। এমনকি কুরআনে নাজিল হয়েছে নারীর নামে একটি স্বাতন্ত্র সুরা। সেসব মর্যাদা ও অধিকারগুলো তুলে ধরা হলো-

>> নারীর মোহরবিয়ে সময় স্ত্রীর জন্য নির্ধারিত মোহর পরিশোধ করা ফরজ। স্ত্রীর মোহরে যে কারো যে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হারাম। তবে স্ত্রী যদি নিজ থেকে স্বামী মোহরের কিছু কমিয়ে দেয় বা ক্ষমা করে দেয় সেটা ভিন্ন কথা। ছাড় দেয়া অংশ স্বামীর জন্য গ্রহণ করা বৈধ। আল্লাহ তাআলা বলেন-আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশী মনে। তারা যদি খুশী হয়ে তা থেকে কিছু অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৪)

Advertisement

>> নারীর অধিকারনারীর জন্য খরচ করার বিধান দিয়েছেন আল্লাহ তাআলা। নারীর যখন সংসার হবে তখন তার যাবতীয় খরচ বহন করবে স্বামী। নারীর সংসারে যদি কোনো অমিল কিংবা কলহ দেখা দেয় তবে দয়া ও অনুগ্রহের মাধ্যমে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন করবে। সম্পর্ক ছিন্ন নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি ও কলহ করা যাবে না। আলাদা হওয়ার ক্ষেত্রে পরস্পর সহযোগিতার মনোভাব পোষণ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন-- ‘স্ত্রীদেরকে স্পর্শ করার আগে এবং কোনো মোহর সাব্যস্ত করার আগে যদি তালাক দিয়ে দাও, তবে তাতেও তোমাদের কোনো পাপ নেই। তবে তাদেরকে কিছু খরচ দেবে। আর সামর্থ্যবানদের জন্য তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী এবং কম সামর্থ্যবানদের জন্য তাদের সাধ্য অনুযায়ী। যে খরচ প্রচলিত রয়েছে তা সৎকর্মশীলদের উপর দায়িত্ব।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৩৬)

- আর যদি মোহর সাব্যস্ত করার পর স্পর্শ করার আগে তালাক দাও, তবে যে মোহর সাব্যস্ত করা হয়েছে তার অর্ধেক দিয়ে দিতে হবে। অবশ্য যদি নারীরা ক্ষমা করে দেয় কিংবা বিয়ের বন্ধন যার অধিকারে সে (স্বামী) যদি ক্ষমা করে দেয় তবে তা স্বতন্ত্র কথা। আর তোমরা পুরুষরা যদি ক্ষমা কর, তবে তা হবে পরহেযগারীর নিকটবর্তী। আর পারস্পরিক সহানুভূতির কথা ভুলে যেয়ো না। নিশ্চয় তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ সেসবই অত্যন্ত ভাল করে দেখেন।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৩৭)

>> নারীর উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠানারী যত ধনীই হোক না কেন আর স্বামী যত গরিবই হোক না কেন, তখনও নারীর যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করার দায়িত্ব স্বামীর। আবার পিতামাতা, স্বামী ও নিকটাত্মীয়দের সম্পত্তিতেও রয়েছে নারীর জন্য সম্মানজনক উত্তরাধিকার। আল্লাহ তাআলা বলেন-‘পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষদেরও অংশ রয়েছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীদেরও অংশ আছে, অল্প হোক কিংবা বেশি- এ অংশ (আল্লাহ তাআলা কর্তৃক) নির্ধারিত।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৭)

>> বিনিময় লাভের মর্যাদাকর্ম-বিশ্বাসের বিনিময় লাভে নারী-পুরুষের মর্যাদা সমান। দুনিয়ার কোনো কর্ম-বিশ্বাসের বিনিময় প্রদানে নারী-পুরুষ কারো প্রতি বৈষম্য করা হবে না। কাউকে বেশি-কম দেয়া হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন-‘যে লোক পুরুষ হোক কিংবা নারী হোক; তারা যদি কোনো সৎকর্ম করে এবং বিশ্বাসী হয়, তবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রাপ্য অধিকার তিল পরিমাণও নষ্ট করা হবে না।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১২৪)

Advertisement

>> নারী নির্যাতন রোধের নির্দেশনারীকে কষ্ট দেয়া যেমন নিষেধ তেমনি নারী থেকে মোহর ফেরত নেয়াও সম্পূর্ণ নিষেধ। নারীর প্রতি সদয় হতে নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ তাআলা। আল্লাহ তাআলা বলেন-

- ‘হে ঈমাণদারগণ! জোরপূর্বক নারীদের উত্তরাধিকার গ্রহণ করা তোমাদের জন্যে হালাল নয় এবং তাদেরকে আটক রেখো না যাতে তোমরা তাদেরকে যা প্রদান করেছ তার কিয়দংশ নিয়ে নাও; কিন্তু তারা যদি কোনো প্রকাশ্য অশ্লীলতা করে! নারীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন কর। অতপর যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে হয়ত তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ, অনেক কল্যাণ রেখেছেন।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১৯)

- ‘আর যদি তোমরা এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী পরিবর্তন করতে ইচ্ছা কর এবং তাদের একজনকে প্রচুর ধন-সম্পদ প্রদান করে থাক, তবে তা থেকে কিছুই ফেরত গ্রহণ করো না। তোমরা কি তা অন্যায়ভাবে ও প্রকাশ্য গোনাহর মাধ্যমে গ্রহণ করবে?’ (সুরা নিসা : আয়াত ২০)

- ‘তোমরা কিভাবে তা গ্রহণ করতে পার, অথচ তোমাদের একজন অন্য জনের কাছে গমন এবং নারীরা তোমাদের কাছে থেকে সুদৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছে।’ (সুরা নিসা : আয়াত ২১)

>> ‍নারী-পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বনারী-পুরুষের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মহান আল্লাহ কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের ওপর নারীদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে নারীদের ওপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। কিন্তু কেউ যেন কারও বৈশিষ্ট্য বা অধিকার নিয়ে বিতর্ক না করে সে ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। আল্লাহতাআলা বলেন-‘আর তোমরা আকাঙ্ক্ষা করো না এমন সব বিষয়ে যাতে আল্লাহ তা'আলা তোমাদের একের উপর অপরের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। পুরুষ যা অর্জন করে সেটা তার অংশ এবং নারী যা অর্জন করে সেটা তার অংশ। আর আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা'আলা সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৩২)

>> ইবাদতের ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদাইবাদত-বন্দেগি ও আল্লাহর সন্তুষ্টিতেও পুরুষরা নারীদের সঙ্গী। উভয়কেই ইবাদতের আদেশ দেয়া হয়েছে। সবাইকে তাদের ইখলাস, চেষ্টা ও কর্ম অনুযায়ী সওয়াব ও বিনিময় পাবে। এতে কারও প্রতি বৈষম্য করা হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন-

‘নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ ও নারী, মুমিন পুরুষ ও নারী, অনুগত পুরুষ ও নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও নারী, বিনয়াবনত পুরুষ ও নারী, দানশীল পুরুষ ও নারী, সিয়ামপালনকারী পুরুষ ও নারী, নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজতকারী পুরুষ ও নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও নারী, তাদের জন্য আল্লাহ মাগফেরাত ও মহা প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন।’ (সুরা আহজাব : আয়াত ৩৫)

>> বিবাদ মীমাংসায় নির্দেশনাদাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া বিবাদ হতে পারে। এ অবস্থায় করণীয় এবং নীতিমালাও নির্ধারণ করেছে ইসলাম। স্বামী-স্ত্রী যে কেউ অবাধ্য হলে তাদের সঙ্গে পারস্পরিক আচরণ কেমন হবে সে সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

‘যদি কোনো নারী নিজ স্বামীর পক্ষ থেকে অসদাচরণ কিংবা উপেক্ষার আশংকা করে, তবে পরস্পর কোনো মীমাংসা করে নিলে তাদের উভয়ের কোনো গোনাহ নেই। মীমাংসা উত্তম। মনের সামনে লোভ বিদ্যমান আছে। যদি তোমরা উত্তম কাজ কর এবং আল্লাহকে ভয় কর, তবে, আল্লাহ তোমাদের সব কাজের খবর রাখেন। (সুরা নিসা : আয়াত ১২৮)

>> কন্যা শিশুর প্রতি বৈষম্য নিরসনযারা কন্যা শিশু হলে অপমানবোধ করে, তাদের জন্য সুসংবাদ দিয়েছেন আল্লাহ। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত। তাকে যে সংবাদ দেয়া হয়েছে, সে দুঃখে সে জাতির কাছ থেকে আত্মগোপন করে। অপমান সত্ত্বেও কি একে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে? জেনে রেখো, তারা যা সিদ্ধান্ত নেয়, তা কতই না মন্দ!’ (সুরা নাহল : আয়াত ৫৮-৫৯)

>> নারীদের প্রতি অপবাদ দেয়ার শাস্তিনারীদের প্রতি যে কোনো অপবাদ দেয়াকে আল্লাহ তাআলা কঠোর হুশিয়ারি দিয়ে সতর্ক করেছেন। অপবাদের শাস্তি ঘোষণা করে আল্লাহ বলেন-‘যারা সচ্চরিত্র সরলমনা মুমিন নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’ (সুরা নুর : আয়াত ২৩)ৎ

>> স্বামী-স্ত্রী সুসম্পর্ক স্থাপনবিয়ে আল্লাহর মহা অনুগ্রহ। বিয়ের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী মাঝে প্রেম-ভালোবাসা ও সুন্দর দাম্পত্য জীবন তৈরি হয়। তাদের পারস্পরিক সুসম্পর্ক সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-‘আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে সে জাতির জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে, যারা চিন্তাভাবনা করে।’ (সুরা রুম : আয়াত ২১)

>> সতিত্ব রক্ষা নির্দেশইসলাম নারীকে সতিত্ব রক্ষার অধিকার দিয়েছে। আর পুরুষকেও গুরুত্ব দিয়েছে যাতে তাদের সতিত্বের অধিকার সংবরণ করে। আল্লাহ বলেন-

- ‘মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।’ (সুরা নুর : আয়াত ৩০)- ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে।’ (সুরা নুর : আয়াত ৩১)

এছাড়াও নারীদের পর্দা পালন থেকে শুরু করে উত্তরাধিকারের বিষয়ে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। যেসব বর্ণনায় নারীদের অধিকার ও মর্যাদাগুলো সুষ্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে।

নারীদের অধিকারগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন হলেই ব্যক্তি পরিবার ও সমাজে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। বিনির্মাণ হবে সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ সোনালী সমাজ।

এমএমএস/এমকেএইচ