মতামত

মাশরাফির বিদায়েও খানিকটা ধোঁয়াশা

ক্রিকেট ক্রিয়েটস কালচার। তবে ক্রিকেট কি শুধুই সংস্কৃতি তৈরি করে! নাকি সংস্কৃতিকে ধারণও করে। বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি কতটা সমৃদ্ধ তা প্রশ্নবিদ্ধ। সে রকম একটা ক্রিকেট প্লেয়িং দেশে একজন অধিনায়ক জনমানসে অন্যরকম একটা ভাবমূর্তি তৈরি করতে পেরেছিলেন, এর বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা আছে। কীভাবে সম্ভব হলো তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। ভিন্নমত থাকতে পারে। তবে দিনশেষে ওয়ানডে ইতিহাসে তিনি এখন অব্দি সফলতম এবং জনপ্রিয় অধিনায়ক। তার বিদায় কতটা আড়ম্বরপূর্ণ হলো, কিংবা আরও কতটা আড়ম্বরপূর্ণ হতে পারত তা নিয়ে শব্দ খরচ করে লাভ নেই। তাতে অধিনায়ক মাশরাফির নামের পাশে আর কোনো স্কোর যোগ হবে না।

Advertisement

মাশরাফি বিন মর্তুজা এখন প্রাক্তন। বাংলাদেশের প্রাক্তন অধিনায়ক। অধিনায়কত্ব সাময়িক ব্যাপার। তবে একবার অধিনায়ক হলে একটা স্থায়ী অর্জনও হয়ে যায়। যিনি একবার প্রাক্তন। তিনি চিরকাল প্রাক্তন। আমৃত্যু প্রাক্তন। এই প্রাক্তনী বড্ড বিচিত্র। একদিকে অতীতের সূচক। অতীতের অন্য নাম। বিগত দিনের কর্মস্বীকৃতি। তাই মাশরাফির বিদায় অনেক রকম শিরোনাম হয়ে উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। সেখানে আবেগ আছে। ইতিহাস আছে। ভবিষতের ইঙ্গিত আছে।

অধিনায়ক মাশরাফির বিদায়। যাকে অনেকে বলেছেন একটা যুগের অবসান! হয়তো তাই। যারা কর্মময় সফল এক অধ্যায়কে পেছনে রেখে যান, তাদের সরে যাওয়া মানেই তো যুগাবসান। সেটা ক্রিকেটের বাইশ গজ থেকে হোক কিংবা জীবনের বাইশ গজ থেকেই হোক। বাংলাদেশ ক্রিকেট অধিনায়ক মাশরাফির শূন্যতা অনুভব করবে কি করবে না সেটা সময় বলে দেবে। তবে ক্রিকেটানুরাগীরা একটা শূন্যতাবোধ করছেন। সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। সেটা মাশরাফির পারফরম্যান্সের কারণে নয়। তার নেতৃত্বেগুণের চেয়েও বেশি দলে ব্যক্তি মাশরাফির অভাব।

দলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘ফাদার ফিগার’। অথচ অমায়িক নিরহংকার এক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশ দলে যার উপস্থিতি, মতামত, ক্রিকেটারদের মূল্যায়ন, তাদের আগলে রাখা, সবাই ছিল। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়ন নেতার মতো প্রতিবাদী ভূমিকায় কখনও নামেননি। ক্রিকেটীয় সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হয়ে যুক্তিতর্ক, ক্রিকেট-বোধ দিয়ে দলের প্রয়োজনে বোর্ডকর্তাদের মতামতকে ভুল প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। নিজে টিম স্পিরিটে বিশ্বাসী ছিলেন। মনপ্রাণ উজাড় করে দিয়ে ক্রিকেট খেলেছেন। ক্রিকেটকে ভালোবাসতে না পারলে, ক্রিকেটের জন্য কোনো ব্যক্তি সাত-সাতবার ডাক্তারের অপারেশন টেবিলে পা তুলে দিতেন! পায়ে ছুরি-কাঁচি চালানোর পর এভাবে বারবার বাইশ গজে ফিরতে পারতেন? এই একটা জায়গায় মাশরাফি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। চ্যাম্পিয়নরা কীভাবে বারবার ফিরে আসেন, তার নজির দেখিয়ে গেছেন ম্যাশ। কিন্তু এই স্পিরিটটা দলের মধ্যে কতটা ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন, সেটা উপলব্ধি করা যাবে তার অনুপস্থিতিতে।

Advertisement

পরিসংখ্যানে লেখা থাকবে মাশরাফি বাংলাদেশকে ৮৩টা ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জিতেছেন ৫০টিতে। জয়ের হাফ সেঞ্চুরি পূরণ করেই তিনি বিদায় নিলেন। তবে এই পরিসংখ্যান বা সংখ্যাগুলো হলো তার ক্রিকেটীয় সাম্রাজ্যের খেরোখাতা। কিন্তু তার প্রতিভা-দক্ষতা-জয়ের ক্ষুধা এসব কি আর সেখানে লেখা থাকবে! থাকলেও একসময় এই সব পরিসংখ্যান পরিণত হয় রীতিমতো ধুলোজমা বইয়ের পাতা। আর সেই পাতা উল্টে দেখতে পারে ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ কিছু মানুষ। তাদের সেই পাতা উল্টানো দেখে মনে হবে, পুরোনো বইয়ের স্তূপে চোখে ছাঁনিপড়া কোনো বৃদ্ধ তাকিয়ে আছেন!

কিন্তু তার অধিনায়কত্ব? বা নেতৃত্বগুণ সেটা মাপার নিক্তি কী হবে? কীভাবে তৈরি হলেন একজন ক্যাপ্টেন মাশরাফি? উত্তর একটাই। নিজেই নিজের ভেতর এই গুণটা তৈরি করেছিলেন এবং সেটা অন্যের চোখের আড়ালে। নিজের ভেতর মনকে খুব যত্নে। সামান্য থেকে অসামান্য হতে তার নিজের অনেক ঘাম-রক্ত-শ্রম ঝরাতে হয়েছে। অনেকের অনেক অবজ্ঞা-উপেক্ষা সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু সেই তিনি আবার অন্যদের ভুল প্রমাণ করে নিজেই সামান্য থেকে অসামান্য হয়ে উঠেছেন। যারা তাকে বাতিলের খাতায় রেখে দিয়েছিলেন তারাই আবার সবার আগে তার নামটা লিখেছেন। এক নিমিষে তিনি সামান্য থেকে অসামান্যের আলোক ছড়িয়েছেন! সেই আলোকে এখনও অনেকে খুঁজবেন।

কিন্তু কতদিন? বাঙালি যে খুব দ্রুত অতীত ভুলে যায়। উদাহরণ আছে ভুরি ভুরি। সেটা শুধু ক্রিকেটে নয়। জাতীয় পর্যায়েই। স্মৃতিভ্রষ্ট সেই জাতি অধিনায়ক মাশরাফিকে কতদিন মনে রাখবে প্রশ্নটা মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে। তাতে অনেকেই হয়তো ভুল বুঝতে পারেন। কিন্তু কিছু করার নেই বরং অনাগত দিনে যদি নিজে ভুল প্রমাণিত হই, তাতেই বেশি খুশি হব। কারণ মাশরাফি ক্রিকেট খেলেছিলেন মন দিয়ে। হৃদয় দিয়ে ক্রিকেটটাকে ভালোবেসে। দিনশেষে ক্রিকেট একটা খেলা। আনন্দ পাওয়া আর আনন্দ দেয়াই যেখানে বড় ব্যাপার। মাশরাফিকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা কিছু ক্রিকেটীয় সুখানুভূতি তিনি দিয়েছেন। একজন ক্রিকেটানুরাগী হিসেবে তাকে খুব তাড়াতাড়ি ভুলতে চাই না।

অধিনায়ক মাশরাফির বিদায় কতটা আড়ম্বরে হলো জানি না। বাংলা শব্দকোষে ‘আড়ম্বর’ শব্দটার একটা অর্থ ‘মহারব’। সেই মহারবের মধ্য দিয়েই তো বিদায় নিলেন অধিনায়ক মাশরাফি। তার বিদায়কে রাঙিয়ে দিতে সবকিছুই করেছেন তার টিমমেটরা। রেকর্ডময় এক ম্যাচ উপহার দিলেন তারা অধিনায়ককে। সঙ্গে বিশাল ব্যবধানে জয়। বসন্তে ক্রিকেটীয় উৎসবে বৃষ্টিও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ম্যাচ শেষে টিমমেটদের কাঁধে চড়ে মাঠ ছাড়লেন মাশরাফি।

Advertisement

কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির পতাকাটা আরও উঁচুতে তুলে ধরার দায়িত্ব যাদের কাঁধে রেখে গেলেন, তারা যদি সফল হন, তাহলে সবচেয়ে খুশি হওয়ার কথা মাশরাফির। দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতির অন্তরাত্মাকে তিনি চেনার চেষ্টা করেছেন নিজের মতো করে। আগামী প্রজন্ম কীভাবে জানবে সেটা সময় বলে দেবে।

তবে অধিনায়ক মাশরাফি ক্রিকেট সংস্কৃতি আর সভ্যতাকে বর্ম চাপিয়ে নীরব যোদ্ধার মতো লড়াই করেছেন দেশের হয়ে। দলের জন্য। টিমমেটদের জন্য এবং নিঃশব্দে। মানসিক দৃঢ়তা, খাদের কিনার থেকে বারবার ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তিনি দেখিয়েছেন। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই অধিনায়কের জন্য ইস্পাত কঠিন স্নায়ুর প্রমাণ দিয়েছেন তার দলের সিনিয়র-জুনিয়ররা। কারণ তিনি ছিলেন নেতা। একতার প্রতীক। দলের বিপদে। প্রাণান্তকর চাপের মুখে। তাই নিজের বিদায়বেলায় সেই টিমমেটদের কাউকে কাউকে মিস করলেন। আক্ষেপটা চেপে রাখেননি মাশরাফি।

অধিনায়ক মাশরাফি বিদায় নিলেন। কিন্তু সিলেটে ক্রিকেট বসন্তের উৎসবে একটা ধোঁয়াশা থেকেই গেল। মাশরাফি কি তার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটা খেলে ফেললেন!

লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।

এইচআর/বিএ/পিআর