# লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রফতানি আয় ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ কম # গোটা অর্থনীতি বড় সংকটে পড়ার শঙ্কায়
Advertisement
চলতি অর্থবছরের শুরুতেই হোঁচট খায় দেশের রফতানি আয়। সেই হোঁচটের নেতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে রফতানিখাতে। চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রফতানিখাতে যে আয় হয়েছে, তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ কম। অর্জিত এ আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম। অর্থবছরের বাকি চার মাসেও রফতানি আয় ইতিবাচক ধারায় ফিরবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে চোখ রাঙাচ্ছে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস।
রফতানিখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগদ প্রণোদনা ও সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের পরও রফতানি আয় কমছে। তৈরি পোশাক, চামড়া, প্লাস্টিকসহ বড় বড় খাতে আয় কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে সার্বিক রফতানিখাতে। এছাড়া বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা কম থাকায় অর্ডারও কমছে। সঙ্গে পণ্যের মূল্যও কমে গেছে। পাশাপাশি দেশের অবকাঠামোগত সমস্যা, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন না করা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহারসহ বিভিন্ন কারণে রফতানি বাণিজ্যে নেতিবাচক ধারা রয়েছে। আগামীতে এ অবস্থা হবে আরও ভয়াবহ। কারণ এরই মধ্যে বিশ্ববাজারকে হেলিয়ে দিয়েছে চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস। চীন ছাড়িয়ে এশিয়া-ইউরোপ-আমেরিকা- সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া এ মহামারি যদি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে, তাহলে রফতানি বাণিজ্য বড় ক্ষতির মুখে পড়বে।
বৃহস্পতিবার (৫ মার্চ) রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) পণ্য রফতানিতে আয়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয় ৩ হাজার ৬ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। এর বিপরীতে রফতানি আয় হয়েছে ২ হাজার ৬২৪ কোটি ১৮ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ কম এবং একই সঙ্গে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম।
Advertisement
পোশাকখাতে অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রফতানি আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ কম
ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একক মাস হিসাবে গত ফেব্রুয়ারিতে রফতানি আয় হয়েছে ৩৩২ কোটি ২৩ লাখ ডলার। এ সময় লক্ষ্য ছিল ৩৭২ কোটি ২০ লাখ ডলার। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ফেব্রুয়ারিতেই আয় কমেছে ১০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এ মাসে প্রবৃদ্ধিও কম হয়েছে ১ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রফতানি করে আয় হয় ৩৩৮ কোটি ৩২ লাখ ডলার।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে মোট রফতানি আয়ে পোশাকের অবদান ৮৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। তবে হোমটেক্স, টেরিটাওয়েলসহ এ খাতের অন্যান্য রফতানির উপখাত হিসাব করলে তৈরি পোশাক খাতের অবদান ৮৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। তৈরি পোশাকের রফতানি কমার মানে এর প্রভাব পুরো রফতানিখাতে পড়েছে।
ইপিবির তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি শেষে পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ২ হাজার ১৮৪ কোটি ৭৪ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ কম। একই সময়ে রফতানি প্রবৃদ্ধিও কমেছে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
Advertisement
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, এ অর্থবছরের শুরু থেকে বলে আসছি তৈরি পোশাকের ব্যবসা কম। বিশ্ববাজারে পোশাকের ব্যবসা কমছে। পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আমরা যতটুকু পিছিয়ে আছি; আমাদের ব্যবসা ততটুকু কমেছে। কিন্তু আমাদের রফতানি প্রবৃদ্ধি বাড়ার কথা ছিল। শুধু তাই নয়, আগের তুলনায় আমাদের ব্যবসাও ৫ শতাংশ কমে গেছে। দিন দিন খরচ বাড়ছে। সব মিলিয়ে পোশাক খাত বড় চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আগামীতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা মুশকিল হবে।
অর্থবছরের প্রথম আট মাসে কেবল পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতেই আয় বেড়েছে
বিশ্ব-অর্থনীতিতে করোনাভাইরাস বড় ধরনের ধাক্কা দিলেও বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব নিয়ে এখনই কথা বলতে চান না সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে কথা বলা যাবে না। তবে এটি ইউরোপে দেখা দিয়েছে। এর পরিধি বাড়লে আমাদের রফতানি বাণিজ্য ভয়াবহ রূপ নেবে।
রফতানি বাণিজ্য ইতিবাচক ধারায় ফেরাতে কী করা দরকার- জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমাদের নতুন নতুন বাজার খুঁজতে হবে। এক পণ্যের ওপর নির্ভর না করে রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা চলমান পোশাকখাতের দুরবস্থা থেকে উত্তরণে জরুরি ভিত্তিতে পোশাকখাতে সরকারের নগদ প্রণোদনা দেয়া দরকার।
পোশাকশিল্পের বাইরে অন্য খাতগুলোতেও রফতানি আয় কমেছে। ইপিবির তথ্যানুসারে, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি শেষে কৃষিপণ্য রফতানিতে আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ কম হয়েছে। আট মাসে কৃষিপণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ৬৬ কোটি ৭৩ লাখ ডলার।
এই সময়ে প্লাস্টিকপণ্য রফতানিতেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হয়েছে আয়। কমেছে প্রবৃদ্ধির পরিমাণও। আট মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্লাস্টিকপণ্য রফতানিতে আয় হয়েছে ২৩ দশমিক ৯১ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রা ৯ কোটি ৯১ লাখ ২০ হাজার ডলার থাকলেও হয়েছে ৭ কোটি ৫৪ লাখ ২০ হাজার ডলার।
বিশ্ব-অর্থনীতিকে হেলিয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস
আট মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানিতেও অর্জন হয়নি লক্ষ্যমাত্রা। কমেছে প্রবৃদ্ধি। এ পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ৬৩ কোটি ৭৬ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ দশমিক ৫১ শতাংশ কম। প্রবৃদ্ধিও কমেছে ৯ দশমিক ০৪ শতাংশ।
এ সময় বেড়েছে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি শেষে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতারি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ৬৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৮ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি। প্রবৃদ্ধিও গত বছরের একই সময়ের চেয়ে এই আট মাসে হয়েছে ২৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পণ্য রফতানি করে ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলার আয় করে বাংলাদেশ।
চলতি অর্থবছর (২০১৯-২০) রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৪ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে পণ্যখাতে রফতানির টার্গেট সাড়ে ৪৫ বিলিয়ন এবং সার্ভিস সেক্টরে সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের রফতানি আয়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি।
জানা গেছে, দেশে শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং ভোগ্যপণ্য আমদানির প্রায় ৩৫ শতাংশ আসে চীন থেকে। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের কারণে এক মাস ধরে চীনের সঙ্গে সব ধরনের আমদানি-রফতানি বন্ধ রয়েছে। যার প্রভাবে ইতোমধ্যে অস্থির হয়ে উঠেছে ভোগ্যপণ্যের বাজার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে অস্থিরতার প্রভাব পড়বে দেশের শিল্প উৎপাদন, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য, সরবরাহ ব্যবস্থা ও সেবাখাতেও। ফলে গোটা অর্থনীতি বড় সংকটে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এসআই/এইচএ/জেআইএম