জয়পুরহাটে সাবেক অতিরিক্ত সচিবের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে কিডনি কেড়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। জেলার কালাই উপজেলাধীন উদয়পুর ইউনিয়নের বহুতি গুচ্ছ গ্রামের দরিদ্র ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত নজরুল ইসলামের স্ত্রী আয়রন নেছাকে চুরির মামলার ফাঁদে ফেলে সাবেক অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ আমিনুর রহমান। মূলত, তার ছেলের জন্য অসহায় ওই নারীর কিডনি কেড়ে নিয়েছেন।জানা গেছে, জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের বহুতি গুচ্ছ গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলামের স্ত্রী আয়রন নেছা। স্বামীর অসুস্থতা আর তিন মেয়ে নিয়ে অভাবের সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে ১০ মাস আগে পাড়ি জমান ঢাকায়। পরিচিত এক লোকের মাধ্যমে সচিবালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব আমিনুর রহমানের বাড়িতে গৃহ পরিচারিকার কাজও নেন। কিছুদিন পর ওই কর্মকর্তার ছেলের প্রয়োজনীয় কিডনির টার্গেট হন আয়রন। মুঠোফোনে বিষয়টি আয়রন তার স্বামীকে জানালে গ্রামে তাকে ফিরে আসতে বলেন স্বামী। পালিয়ে গ্রামে আসলেও সেই চতুর কর্মকর্তা পিছু ছাড়েননি তার। গুলশান থানায় চুরির মামলা করে পুলিশ দিয়ে স্বামীসহ আয়রনকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়। ভয়ে কিডনি দেয়ার শর্তে রাজি হলে কয়েকদিন পর জামিনে মুক্ত করে ভারতের ব্যাঙ্গালোরের এক হাসপাতালে তার একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় ছেলে নাফিজের শরীরে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে থাকা এ নারী যেন এখন এই সমাজের বিক্ষুব্ধ প্রতিমূর্তি। সংবাদকর্মী দেখলেই ঝাঁঝালো কণ্ঠে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, তখন কোণ্টে গেছিলিন তোমরাই, যখন জোর করি ধরি হামাক আর হামার সোয়ামিক মিথ্যা চুরির অপরাধে ধরে লিয়ে সারারাত কালাই থানায় আটকে থুয়ে ঢাকায় ধরে লিয়ে গেল। তারপর ইন্ডিয়াত লেযায়্যা হামার কিডনি খুলে লিল। ওই সাবেক আমলা ভারতে নিয়ে গিয়ে ছেলের শরীরে কিডনি প্রতিস্থাপন করার পর দেশে ফিরে মাত্র আড়াই লাখ টাকা দিয়ে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ করে আয়রন নেছা বলেন, এ ব্যাপারে কাউকে কিছু জানালে বা বেশি বাড়াবাড়ি করলে সারাজীবন জেলে পঁচে মরতে হবে বলেও হুমকি দেন ওই সাবেক বড় কর্তা। এ কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন আয়রন। মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ৭ নভেম্বর সাবেক অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ আমিনুর রহমান গুলশান থানায় গৃহকর্মী আয়রন নেছার নামে ৩৮১ ধারায় (চুরি করার অপরাধ) একটি অভিযোগ দায়ের করেন, পরে অভিযোগটি মামলায় রেকর্ড হয়। যার মামলা নম্বর-১০। মামলায় চুরিকৃত মালামালের মূল্য দেখানো হয় আট লাখ টাকা। মামলার বিবরণে সাবেক আমলা সৈয়দ আমিনুর রহমান উল্লেখ করেন, বেশ কিছুদিন আগে আমার মেয়ের বিয়ে হয়। ঘটনাচক্রে আমার মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার পুনট পাঁচ লাইশ গ্রামের ব্যবসায়ী আয়রনের জামাই জহুরুলের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনিই তার শাশুড়িকে আমার বাসায় গৃহকর্মীর কাজে পাঠান। আরও বলা হয় কয়েকদিন আগে আয়রন নেছার স্বামী বিভিন্ন অছিলায় আমার বাসায় থাকেন। ২০১৪ সালের ৪ নভেম্বর মাগরিবের নামাজের পর থেকে আয়রন নেছা ও তার স্বামী নজরুল ইসলামকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাসায় জিনিসপত্র তল্লাশি করে দেখা যায়, আমার সদ্য বিবাহিত মেয়ের ১২ ভরি সোনার গয়না ও নগদ ২ লাখ টাকা নেই। গত দুই দিন বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে তাদেরকে পাওয়া যায়নি। তবে তারা মালামাল চুরি করে গ্রামের বাড়িতে লুকিয়ে আছেন বলে জানা গেছে। এ অভিযোগে মামলা দায়েরের দুই দিনের মাথায় গুলশান থানা পুলিশের সহায়তায় জয়পুরহাটের কালাই থেকে আয়রন নেছা ও তার স্বামীকে গ্রেফতার করে আনা হয়। আয়রন নেছা বলেন, বিভিন্ন এনজিও ও দাদন ব্যবসায়ীর কাছে প্রায় এক লাখ পঁচিশ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এতে প্রতি সপ্তাহে তাকে কিস্তি দিতেই কষ্ট করে রোজগারের সব টাকা শেষ হয়। এরপর আগের মতোই খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে। বাধ্য হয়ে কামাল নামে এক লোকের সঙ্গে তিনি ঢাকায় যান গার্মেন্টসে চাকরির আশায়। কিন্ত যে পারিশ্রমিক পাওয়া যেত তা দিয়ে কিস্তি শোধ করা তো দূরের কথা ঢাকায় থেকে নিজের চলাই দায় হয়ে যায়। তারপর ওই সেই বড় কর্তার বাসায় ঝিয়ের কাজ নেন, এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন আয়রন। আয়রন নেছার স্বামী নজরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ওই বড় কর্মকর্তা আমিনুর রহমান এক দিকে মামলার ভয় অন্যদিকে মোটা অঙ্কের টাকার লোভ দেখিয়ে বিদেশ নিয়ে গিয়ে তার স্ত্রীর কিডনি নিয়ে ওয়াদা মতো সেই পরিমাণ টাকাতো দেয়ইনি, প্রতিশ্রুতি দেয়া সেই পরিমাণ টাকা চেয়ে অনুনয় বিনয় করলে উল্টো আবারো মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেন। এই বলে কান্নায় গামছায় মুখ লুকান নজরুল।এ ব্যাপারে কালাই থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, আয়রন নেছার বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন। তবে এ ব্যাপারে এখনো কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তারপরও আয়রন নেছাসহ সকল ভুক্তভোগীদের বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে এবং দোষীদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ জোর তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।শুধু আয়রন নেছাই নয়, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ যাবৎ কালাই উপজেলার মাত্রাই, উদয়পুর ও আহম্মেদাবাদ ইউনিয়নের প্রায় চার শতাধিক দরিদ্র মানুষের কিডনি গেছে দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে। আবার অনেকে নিজের কিডনি বিক্রির পর নিজেও কিডনি বিক্রির দালাল বনে গেছেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।মাত্রাই ইউপি চেয়ারম্যান আ ন ম শওকত হাবিব তালুকদার লজিক, উদয়পুর ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম চৌধুরী ও আহম্মেদাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান আবুল খায়ের মো. গোলাম মওলা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জাগো নিউজকে জানান, মানবদেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ক্রয় বিক্রয় আইনত দণ্ডনিয় অপরাধ জেনেও রোগী ও কিডনি দাতার মাঝে মিথ্যা সম্পর্ক দেখিয়ে এক শ্রেণির দালাল চক্র বিভিন্ন দেশে নিয়ে গিয়ে কিডনি স্থানান্তর করছে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল, ভারতের কলম্বিয়া এশিয়ান হাসপাতাল, ফ্রটিশ হাসপাতাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন হাসপাতালে এসব কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট হচ্ছে। অবৈধভাবে এদেশে কিডনি ম্যাচিং ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ করছে বিএসএমএমইউ, কিডনি ফাউন্ডেশন, ইউনাইটেট, ল্যাবএইড, অ্যাপোলো ও পপুলার নামের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এলাকার কিডনি দাতা, পুলিশসহ বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে তারা এসব কথা জানতে পারেন বলেও তারা জানান।কালাই উপজেলা চেয়ারম্যান মিনফুজুর রহমান মিলন জাগো নিউজকে জানান, দ্রারিদ্রতা, দাদন ব্যবস্যায়ীর কাছ থেকে উচ্চহারে সুদ, একই ব্যক্তিকে একাধিক সংস্থা থেকে ঋণ প্রদান, স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞানের অভাব, দালালদের প্ররোচনা, অলস জীবন যাপনের প্রবণতা ইত্যাদি কারণ থেকে এ এলাকায় কিডনি বিক্রি শুরু হয়েছে এবং এখন তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।জয়পুরহাট পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, অবৈধভাবে কিডনি বিক্রি রোধে দালালদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে পুলিশ কাজ করছে। সচেতনতা হলো এর প্রতিকারের প্রধান পন্থা। জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক আব্দুর রহিম জাগো নিউজকে জানান, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসন থেকে লিফলেট বিতরণ, প্রামান্য চিত্র প্রদর্শনসহ সচেতনতামূলক নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। রাশেদুজ্জামান/এমজেড/এমএস
Advertisement