মতামত

পাপিয়াকাণ্ডের তালিকায় যেভাবে আমার নাম প্রকাশ হলো!

জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবদানের জন্য বিশেষ সন্মাননায় ভূষিত হয়েছি। খুব বেশি লোকে জানে না। ইউনেস্কো জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ডে বিচারক ছিলাম পরপর দু’বছর। সেটাও অনেকে জানে না। কানাডিয়ান জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ডে ছিলাম সন্মানিত জুরিদের একজন, অনেকেরই অজানা। বন্ধু মিডিয়া ফেলোশিপ অ্যাওয়ার্ডে শুরুর দিকটায় পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি, সেটিও জানা নেই অনেকের। তুলনামূলকভাবে অনেক কম বয়সে বেশি সম্মান পেয়েছি।

Advertisement

সত্যি বলতে কী, লক্ষ্য করে দেখেছি লোকে ভালো খবরের চেয়ে মন্দ খবর রাখে বেশি। মন্দ খবর জানতে, অন্যের বিষাদগার পড়তে, কুকথা পড়তে আগ্রহ বেশি লোকের। দায়িত্ব নিয়ে বলছি, সম্পাদক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি ভালো খবর, ইতিবাচক খবর, উন্নয়নের খবরের চেয়ে নেতিবাচকতার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি। আর সোশ্যাল মিডিয়ার এই সময় শুধু নেতিবাচকই নয়, আজগুবি, উদ্ভট, বানোয়াট, কল্পিত, অসত্য, অর্ধ-সত্য, নোংরা, অশ্লীল, যৌনউত্তেজক খবরই বেশি ভাইরাল।

এই মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে-কটি আলোচিত ইস্যু রয়েছে তার মধ্যে ‘পাপিয়াকাণ্ড’ অন্যতম। সাবেক এই যুব মহিলালীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, পতিতাবৃত্তি, চাঁদাবাজি, প্রতারণা এমন অসংখ্য অভিযোগ। পাপিয়া ইস্যুটি তদন্তাধীন। এখনো জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। সে খবর প্রায় প্রতিদিনই খবরে আসছে। কিন্তু, কিছু গণমাধ্যম এমন খবর প্রচার করছে যা শুধু অশ্লীলই নয়, বানোয়াটও বটে; যা পড়েই বোঝা যায়।

একটি গণমাধ্যমের শিরোনাম- ‘রাগের মাথায় স্বামীর বিচিও চেপে ধরতেন পাপিয়া’। কম গুরুত্বপূর্ণ, তথাকথিত গণমাধ্যম বাদ দিলাম, প্রচার সংখ্যায় এগিয়ে থাকা দু’তিনটি দৈনিকের পাপিয়াকাণ্ডের খবর পড়লে মনে হয়, তারা ‘অশ্লীল চটি’র উন্নত সংস্করণ। চটিতে বানান ভুল থাকে জাতীয় দৈনিকে প্রুফ রিডার থাকায় ভুল নেই পার্থক্য শুধু এতটুকুই।

Advertisement

গত ক’দিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি তালিকা ভাসছে, ঘুরছে। উত্তেজনা ধরে রাখতে না পেরে অনেকে ইনবক্সে তালিকাটি পাঠিয়েছেন আমাকে। বলা হচ্ছে ‘পাপিয়ার ডেরাই নিয়মিত যেতেন যারা’। এটি নাকি অর্ধেক তালিকা, ১২ জনের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। একইরকমভাবে ‘চটির’ কায়দায় ‘ডেরায়’ বানান ভুল। ভুল শুদ্ধের চেয়ে বড় কথা, এটি মিথ্যা ও অপরাধমূলক একটি কর্মকাণ্ড। গুজব প্রচারকারীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটি ছড়িয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ ভাইরাল করেছেন নেহাত পেইজ এবং সাইটের হিট বাড়াতে। যার অধিকার তাদের কাউকে দেওয়া হয়নি। তদন্ত চলমান এখনো।

৩ মার্চ মঙ্গলবার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ডিএমপির বিমানবন্দর এবং শেরেবাংলা নগর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইন ও অস্ত্র আইনে দায়েরকৃত তিনটি মামলা ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করছে। এসব মামলায় শামীমা নূর পাপিয়া, তার স্বামী সুমন, সহযোগী সাব্বির ও তাইবা নূরকে ডিবি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। বিচার্য বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাক্ষীদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুরো বিষয়টি এখনো তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এ পর্যায়ে ডিবির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।

উদ্বেগের কথা জানিয়ে ডিএমপি জানায়, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি কিছু কিছু গণমাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কোনোরকম আলাপ-আলোচনা না করে তদন্ত সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য প্রচার ও প্রকাশ করা হচ্ছে। তদন্তেপ্রাপ্ত কথিত তথ্য হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের নাম-পরিচয় প্রকাশ ও প্রচার করছে। যার সঙ্গে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ততা নেই কিংবা তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে কোনো সামঞ্জস্য নেই।

Advertisement

অনেকটা যৌন উত্তেজনার মতো, ধরে রাখতে না পেরে কেউ কেউ আমাকে মধ্যরাতে ফোনও করেছেন। বলেছেন, ভাই আপনার অনেক ভাই-বন্ধুদের নামও দেখলাম। মোহাম্মদ এ. আরাফাতের নামও, ক্যামনে কী? কাহিনি কী?

কাহিনি আসলে কিছুই নয়, চাঁদে সাঈদীকে দেখার মতো কিংবা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় অভিনেত্রী নওশাবার ‘বাচাঁও বাচাঁও’ কথিত ধর্ষণের মতো, পদ্মা সেতু বানাতে শিশুদের কাটা মুণ্ডু লাগে, অনেকটা সেরকম। এই তালিকা পুরোটাই এমন।

প্রফেসর ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আমার ভীষণ প্রিয় মানুষদের একজন। তার একটি কথা সবসময় স্মরণ রাখি তা হলো, ‘প্রত্যাখান করার শক্তি সবচেয়ে বড়’। অধ্যাপক মোহাম্মদ এ. আরাফাত সেই শক্তিমান মানুষ। যিতি প্রত্যাখান করতে জানেন, পারেন। যা পারেন না এ সমাজের অনেকেই। যিনি কখনোই তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা তা বলে বেড়ান না সুবিধা নেবার জন্য। যিনি ফিরিয়ে দিতে পারেন সরকারের উচ্চপদে অধীন হবার সুযোগ ও প্রস্তাব। যিনি প্রত্যাখান করেছেন ১০ কাঠা সরকারি প্লট। আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার পরও যার জীবন-যাপন খুব সাধারণ, নির্লোভ, নির্মোহ তিনিই মোহাম্মদ এ. আরাফাত। যার স্বার্থ শুধু একটাই- বাংলাদেশ। দেশের পক্ষ। যিনি নিজের অবস্থানকে স্পষ্ট করে বলতে পারেন, ‘আমি সত্য আর মিথ্যার মাঝখান দিয়ে হাঁটার মানুষ নই, জয় বাংলা আর জিন্দাবাদের মাঝামাঝি আমি দাঁড়াই না। সবসময় বাংলাদেশের পক্ষে আমার অবস্থান।’ ফলে তার চরিত্র হনন হবে না, তো হবে কার?

যুগে যুগে তাই হয়েছে, সত্য বলা মানুষকে সাহসী মানুষকে সামাজিকভাবে, ধর্মের দোহাই দিয়ে, কখনো বা রাষ্ট্র হন্তারক হয়েছে। গ্যালিলিও, কোপারনিকাস, জিওদানোব্রুনো, সোলঝিনেৎ সিন ইতিহাসের এই তালিকা বড় দীর্ঘ।

খুব ভুল ধারণা, কেউ ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলেই সততাহীন বলে আমরা ভাবি। মনে রাখবেন, বহুলোক আছেন ক্ষমতাহীন কিন্তু সততাহীনতারও শেষ নেই। সততা, নৈতিকতা, মানবিকতার সঙ্গে সাদা-কালো, উঁচু-নিচু, ছোট-বড়, গরিব-ধনী, ক্ষমতাবান-ক্ষমতাহীনের কোনো সম্পর্ক নেই- বিষয়টা নেহাত ব্যক্তিগত।

আমাদের দার্শনিক দারিদ্র্য প্রবল। বোধের অভাব অনেক। ভালো চাই, কিন্তু ভালো কাজকে, ইতিবাচক ইচ্ছা, প্রবণতাকে এগিয়ে দিতে চাই না, দেই না। বাধা হয়ে দাড়াই নিজেরাই, খুব ক্ষুদ্র, তুচ্ছ স্বার্থের জন্য। যারা গুজব ছড়ায়, মিথ্যা বানোয়াট তালিকা প্রকাশ করে অন্যের চরিত্র হননে একদিন তা ফিরে আসবে নিজেরই কাছে, মনে রাখতে হবে প্রকৃতি বড় ভয়ঙ্কর।

রাজনীতির জবাব দিতে হয় রাজনীতি দিয়ে, অশ্লীলতা, অসভ্যতা দিয়ে নয়।অতএব, সাধু সাবধান!

পুনশ্চ: এই লেখার সঙ্গে শিরোনামের কোনো মিল নেই। যেমন মিল নেই, সম্পর্ক নেই পাপিয়ার সঙ্গে আমার। আমি শুধু দেখাতে চাইলাম, এমন শিরোনাম লোকে অনেক বেশি পড়ে। ক্ষমা করবেন, ভালো থাকবেন।

লেখক: সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।

এইচআর/পিআর