আজ বিশ্ব ডাক দিবস। সারাদেশে ঘটা করে ডাক দিবস পালন করা হলেও ডাক বিভাগের কর্মচারীদের খবর রাখে না কেউ। বিভিন্ন রঙয়ের খামে আটকানো মানুষের সুখ-দুঃখের খবর যারা প্রতিনিয়ত পৌঁছে দিচ্ছেন বাড়ি বাড়ি তারাই চরম অবহেলিত। তাদের দুঃখের কথা শোনার যেন কেউ নেই। চরম মানবেতর অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন কাটে তাদের। শাখা ডাকঘরের কর্মচারীরা মাসিক ভাতা পাচ্ছেন মাত্র ১১শ আশি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১২শ ষাট টাকা। এই যুগে এটা হাস্যকরই বটে। মাসের ত্রিশ দিনতো দূরের কথা ওই টাকায় তিন দিনও সংসার খরচ চলেনা তাদের। মেহেরপুর জেলায় ৩১টি শাখা ডাকঘর রয়েছে। যাতে কর্মরত আছেন ৭৯ জন কর্মচারী। যাদের মধ্যে জেলার গাংনী উপজেলার বাদিয়াপাড়ার আব্দুল মান্নান। তিনি দীর্ঘ বিশ বছর ধরে বাদিয়াপাড়া গ্রাম্য শাখা ডাক ঘরে পোস্ট মাস্টারের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ৪২০ টাকা ভাতাতে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। দীর্ঘ বছরে সেই ভাতা বেড়ে হয়েছে মাত্র ১২শ ৬০ টাকা। বর্তমানে একজন দিনমজুর বা একজন শ্রমিক প্রতিদিন আয় করছেন তিন থেকে চারশ টাকা। অর্থাৎ একজন শাখা ডাকঘরের কর্মচারীর মাসিক ভাতা শ্রমিকের তিন দিনের মজুরির সমান। তার সংসারে চারজন সদস্য। ১২শ ৬০ টাকা দিয়ে কীভাবে সংসার চলে তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। সরকার জানে কি-না তা জানিনা। তিনি আরও বলেন, নির্ধারিত সময়ে ডাক গ্রহণ এবং ডাক বিলি তার নিত্যদিনের কাজ। যার কারণে এ সময়ে অন্য কোনো কাজ করার সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। বাড়ি থেকে অন্য কোথাও যাওয়াও তার জন্য দূরূহ কাজ। সদর উপজেলার গোভীপুর গ্রামের ইউনুস জাগো নিউজকে জানান, দীর্ঘ ২৫ বছর থেকে রানারের কাজ করছেন তিনি। বেলা ১২টার মধ্যে জেলা প্রধান ডাকঘর থেকে ডাক গ্রহণ করে বেলা একটার মধ্যে শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে উজলপুর গ্রামের শাখা ডাকঘরে পৌঁছে দিতে হয়। দিনের মধ্যভাগে এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অন্য কাজ করার সুযোগ থাকে না। নূন্যতম ভাতা দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে তিনি আজ ঋণগ্রস্ত। দুঃখ ছাড়া সুখের মুখ দেখতে পারেননি তিনি। তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে, সম্মানজনক পর্যায়ে ভাতা বাড়বে, আশায় আশায় তিনি এই দীর্ঘ সময় ধরে এ কাজ করে আসছেন। কিন্তু সব আশা আজ নিরাশায় পরিণত হয়েছে। শেষ বয়সে এসে তিনি এখন বড় ক্লান্ত। বাংলাদেশ শাখা ডাক কর্মচারী ইউনিয়ন, মেহেরপুর জেলা শাখার সেক্রেটারি শামীম রেজা জাগো নিউজকে বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ হলেও এখনো ডাকের মাধ্যমে প্রচুর চিঠি আসে। অনেক জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ চিঠিগুলো দায়িত্ব নিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে পৌঁছে দিতে হয় তাদের। একটি শাখা ডাকঘরের আওতায় দশ-বার কিংবা পনের-ষোলটি পর্যন্ত গ্রাম আছে। কোনো কোনো গ্রামের দূরত্ব চার, পাঁচ কিংবা ছয় কিলোমিটার পর্যন্ত। এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডাকের চিঠি, মানি অর্ডার পৌঁছাতে নিদারুণ কষ্ট হয় ডাক পিয়নের। তিনি আরও জানান, সারা দেশে সাড়ে আট হাজার গ্রাম্য শাখা ডাকঘরে কাজ করছেন চব্বিশ হাজার কর্মচারী। যাদের প্রত্যেকেই মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। একটি শাখা ডাকঘরে কাজ করেন একজন পোস্ট মাস্টার, একজন ডাক পিয়ন এবং একজন রানার। একটি শাখা ডাকঘরে সপ্তাহে এক থেকে দেড়শ চিঠি যায়। সেগুলো যথাসময়ে পৌঁছে দিতে হয় প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে। অথচ একজন পোস্ট মাস্টারের মাসিক ভাতা ১২শ ৬০ টাকা, ডাক পিয়নের ১২শ ৩০ টাকা আর রানারের মাত্র ১১শ ৮০ টাকা। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে তারা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অন্য কাজ করার সুযোগও পায় কম। যার কারণে যৎসামান্য টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। ভাতার পরিমাণ মানুষের কাছে বলতেও লজ্জা বোধ করেন অনেকে। তারপরও আশায় আশায় থেকে, সরকারের শুভ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন অসহায় মানুষগুলো। তিনি আরও বলেন, সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রুতি দিলেও আজ পর্যন্ত কোনো প্রতিশ্রুতিই পূরণ হয়নি তাদের। মানবেতর জীবন-যাপনের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে সরকার একটা সম্মানজনক পর্যায়ের ভাতা নির্ধারণ করবেন এমনটিই আশা এসব অবহেলিত ডাক কর্মচারীদের।এমজেড/এমএস
Advertisement