>> বায়ু দূষণের বিশ্ব-মহামারি চলছে>> নতুন ধূমপানের নাম বায়ু দূষণ>> বায়ু দূষণে মৃত্যুহার ধূমপানের হারকেও ছাড়িয়ে যাবে>> বেশি ঝুঁকিতে বৃদ্ধরা
Advertisement
ফুসফুসের সংক্রমণ, ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং স্ট্রোক এসব মারাত্মক রোগের সঙ্গে বায়ু দূষণের সংযোগ রয়েছে। যে কারণে একে ‘নতুন ধরনের ধূমপান’ বলা হচ্ছে। কিন্তু বায়ু দূষণ আমাদের আয়ুর ঠিক কতটা কেটে ফেলতে পারে?
বিজ্ঞানীদের একটি নতুন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ঘরের বাইরের দূষিত বাতাস আমাদের আয়ু গড়ে প্রায় তিন বছর পর্যন্ত কমিয়ে দিচ্ছে, যা আগের যেকোনো গবেষণা ফলাফলের চেয়ে বেশি এবং ধূমপানের ফলে যে পরিমাণ আয়ু কমে তার চেয়েও বেশি।
কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, যুদ্ধসহ সব ধরনের সংঘাতে পৃথিবীতে প্রতি বছর মানুষের আয়ু যতটা কমে, তার চেয়ে প্রায় দশগুণ বেশি গড় আয়ু কমে বায়ু দূষণের কারণে।
Advertisement
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বায়ু দূষণের কারণে প্রতিবছর মৃত্যুর হার ধূমপানের ফলে হওয়া মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে।
এ জন্য ২০১৫ সালে মানুষের গড় আয়ু ও মৃত্যুর হার গণনা করেন, এবং তারা দেখতে পেয়েছেন, বায়ু দূষণের কারণে পৃথিবীতে ৮৮ লাখ মানুষ মারা যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ধূমপানের কারণে প্রতি বছর ৮২ লাখের বেশি মানুষ মারা যায় বিশ্বজুড়ে। এর মধ্যে ৭০ লাখের বেশি মানুষ মারা যায় সরাসরি সিগারেট এবং তামাকজাত পণ্যের ব্যবহারের কারণে।
বিশ্ব মহামারি
Advertisement
দূষিত বায়ুর মধ্যে থাকলে একজন মানুষের হৃদরোগ এবং ফুসফুসের অসুখ হবার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া স্বাস্থ্যের ওপর এর অন্য নেতিবাচক প্রভাব তো আছেই।
গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক থমাস মুনজেল মনে করেন, তাদের গবেষণা প্রমাণ করে যে, এখন বায়ু দূষণের বিশ্ব-মহামারি চলছে।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, এখন নীতি নির্ধারক এবং চিকিৎসকদের বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। ‘গত কয়েক দশকে ধূমপানের তুলনায় বায়ু দূষণের দিকে অনেক কম মনোযোগ দেয়া হয়েছে।’
অধ্যাপক মুনজেল বলছেন, কেবল জীবাশ্ম জ্বালানি নির্গমন যদি শূন্যে নামিয়ে আনা যেত তাহলে মানুষের গড় আয়ু অন্তত এক বছর বাড়ানো যেত।
আঞ্চলিক ও জাতীয় ক্ষতি
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বায়ু দূষণের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলো জাতীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে পড়ে। যেমন- পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে গড় আয়ু চার বছরের মতো হ্রাস পেয়েছে। যেখানে গড় আয়ু সবচেয়ে কম হ্রাস পেয়েছে ওশেনিয়াতে।
এ ছাড়া বায়ু দূষণের প্রভাব একেক দেশে একেক রকম হয়। আফ্রিকার চাঁদে বায়ু দূষণের কারণে গড় আয়ু কমেছে সাত বছরের বেশি, আবার কলম্বিয়াতে কমেছে চার মাসের কিছু বেশি সময়।
মনুষ্যসৃষ্ট নির্গমন
গবেষকেরা মানুষের কারণে হওয়া দূষণ এবং প্রাকৃতিক কারণে হওয়া বায়ু দূষণ - যেমন মরুর লু হাওয়া এবং দাবানলের কারণে হওয়া দূষণ- দুটোই পরীক্ষা করে দেখেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ অকাল মৃত্যুর কারণ যে দূষণ তা মূলত মানুষের সৃষ্টি।
অধ্যাপক মুনজেল বলেন, এ হার উচ্চআয়ের দেশগুলোতে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। তার মানে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে ৫৫ লাখের মতো মৃত্যু পুরোপুরি এড়ানো যেত, যদি বায়ু দূষণ না থাকত।
এ ছাড়া বায়ু দূষণের সঙ্গে ছয় ধরনের রোগ, যেমন উচ্চ রক্তচাপ ও ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো রোগের সংযোগ নিরীক্ষা করে দেখেছে বিজ্ঞানীদের এই দল।
তারা দেখেছেন, এর মধ্যে হৃদরোগের কারণে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়। এরপরেই রয়েছে ফুসফুসের সংক্রমণ। আর বায়ু দূষণের কারণে মৃত্যুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন বয়স্ক ব্যক্তিরা।
আরেকজন গবেষক হোসে লেলিভেল্ড বলেন, আমরা যখন বায়ু দূষণের কারণে হওয়া বিভিন্ন রোগের চিত্র দেখছিলাম, আমরা দেখেছি কার্ডিওভাসকুলার অর্থাৎ হৃদরোগের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে, যা ধূমপান হৃদপিণ্ডের যে ক্ষতি করে প্রায় তার সমান।
‘বায়ু দূষণ অক্সিডেটিভ চাপ বাড়িয়ে মানুষের হৃদপিণ্ডের রক্তনালীর ক্ষতি করে, যা পরে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, হার্ট-অ্যাটাক এবং হার্ট-ফেলের কারণ হয়ে ওঠে।’
বয়স্ক মানুষ বেশি ঝুঁকিতে
গবেষকেরা দেখেছেন বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বিপদে পড়েন বয়স্ক ব্যক্তিরা। সারা দুনিয়ায় এ কারণে যত মৃত্যু হয় তার ৭৫ শতাংশই ঘটে যাদের বয়স ৬০ এর ওপরে।
গবেষণার ফলাফলের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রোগ-তত্ত্ববিদ স্যামুয়েল চাই বলেছেন, এ গবেষণা প্রমাণ করছে যে, বায়ু দূষণ পুরো বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্যই কত বড় হুমকি সৃষ্টি করেছে।
‘বায়ু দূষণ যে নতুন ধূমপান এ তো আর গোপন কথা নয়, সুতরাং জনস্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের এখন এ নিয়ে সিরিয়াস হবার সময় এসেছে।’
এখন বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে নতুন নীতি তৈরি করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
জেডএ/পিআর