মতামত

শেখ হাসিনার সব অর্জন ধুলায় মিশে যাওয়ার আশঙ্কা!

নরসিংদীর আওয়ামী যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়ার নাম এখন আলোচনার শীর্ষে। দেশের অপরাজনীতির প্রতীক হিসেবেই তাকে গণ্য করা হচ্ছে। রাজনীতিতে তার উত্থান বিস্ময়কর। সাধারণত আওয়ামী লীগ কিংবা আওয়ামী লীগের কোনো সহযোগী সংগঠনের কমিটিতে ঠাঁই পাওয়া খুব সহজ কাজ নয়। বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও অনেকে কোনো কমিটিতে ঢুকতে পারেন না। এরজন্য ‘উপরের কানেকশন' লাগে। এই ‘উপর'টা কি কোনো একক ব্যক্তি, নাকি ব্যক্তিসমষ্টি সেটা সম্ভবত কারো স্পষ্ট করে জানা নেই। তবে এটা সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার অনুমোদন ছাড়া মূল দলে অথবা অঙ্গ সংগঠনে কেউ কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ পান না। পাপিয়াও উপরের নির্দেশেই নরসিংদী জেলা মহিলা যুব লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্র জানিয়েছে।

Advertisement

পাপিয়া ছাত্রলীগ করতেন। তার স্বামীও ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেই যুক্ত। তাই পাপিয়াকে নব্য আওয়ামী লীগার বলা যাবে না। তিনি বরং আওয়ামী পরিবারেরই সদস্য। পাপিয়া র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে তার অপকর্ম বা দুষ্কৃতি কারো নজরে আসেনি। না তার সংগঠন, না কোনো গণমাধ্যম কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার মাফিয়া হওয়ার কাহিনি জানতে পারেনি। এ ব্যাপারটাও কম বিস্ময়কর নয়। ২৮ বছর বয়সী নারীর দাপিয়ে বেড়ানো, একধরনের অস্বাভাবিক জীবনযাপন কারো কাছেই সন্দেহজনক মনে হয়নি। তাকে গ্রেফতারের পর এখন কতো কেচ্ছা, কতো কাহিনি! তাকে নিয়ে মুখরোচক গল্প অতিমাত্রায় ছড়িয়ে পড়ার কারণ সম্ভবত দুটি– এক. তিনি নারী, দুই. এখন তিনি খাদে পড়েছেন।

এই যে দিনর পর দিন কেউ কোনো কিছু দেখেন না, কিংবা দেখলেও চুপ থাকা বা চেপে থাকার সংস্কৃতির চর্চা দেশে চলছে, সেটাই কার্যত পাপিয়ার মতো ‘নষ্ট'দের বেড়ে ওঠার পথ করে দিচ্ছে। একটি খারাপ খবর প্রচার হলে কয়দিন সেটা নিয়ে আমরা মাতামতি করি। তারপর আবার পুকুরের পানি শান্ত। সব কিছু নষ্টদের দখলে যাচ্ছে বলে যারা হাপিত্যেশ করেন, তারাও কিন্তু সচেতন বা অবচেতনভাবে নষ্টদেরই সঙ্গে থাকেন। একজন বিত্তহীন সৎ মানুষ এখন সমাজে উপেক্ষিত। বিত্তবান দুর্বৃত্তের আস্ফালন চোখ খুললেই দেখা যায়। ভালো মানুষ বন্ধুহীন এবং বোকা হিসেবে বিবেচিত হন। লুটপাট করে বা যেকোনো অসৎ উপায়ে যিনি গাড়িবাড়ির মালিক হন ‘সম্মান’ তার পায়ে গড়াগড়ি যায়।

পাপিয়ার মতো কম বয়সী একজন নারীর সঙ্গে ১১ জন মন্ত্রী, ৩৩ জন এমপি যোগাযোগ রাখতেন, কথা বলতেন– এটা ভাবা যায়! ওয়েস্টিনের মতো দামী হোটেলে যেসব হোমড়াচোমড়া তার আতিথ্য গ্রহণ করতেন, তাদের পরিচয় কি কোনো দিন জানা যাবে? পাপিয়া অবশ্যই দোষী কিন্তু তার সঙ্গী-সাথী, যাদের দ্বারা তিনি ব্যবহৃত হয়েছেন তাদের নির্দোষ বলা হবে কোন যুক্তিতে? একজনকে বলির পাঁঠা বানিয়ে দশজনকে দায়মুক্তি দিলে কি কখনো অপরাধপ্রবণতা দূর হবে? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, শুধু পাপিয়া নয়, অপকর্ম, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও মাদকের সঙ্গে যারাই জড়িত, তারাও নজরদারিতে আছেন। অপকর্মের পেছনে যারা কলকাঠি নাড়ছেন, তারাও রেহাই পাবেন না।

Advertisement

ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যে কেউ আস্থা রাখতে পারছেন বলে মনে হয় না। ‘কেউ রেহাই পাবে না', ‘কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না’– এসব এখন হাস্যকর বুলিতে পরিণত হয়েছে। এটা ঠিক যে শেখ হাসিনার আমলে দলীয় কিছু ব্যক্তিকে বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিএনপি আমলে এটা ছিল ভাবনার বাইরে। দলীয় পরিচয়ে বা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অপরাধ করা, অন্যায় করা, দুর্নীতি করা একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ এই ধারার বাইরে যেতে পারেনি। অসংখ্য অভিযোগের মধ্যে দু'চারজনকে ধরলে এবং অন্যদের ব্যাপারে চোখ বন্ধ রাখলে মানুষের মধ্যে এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়ে না।

আওয়ামী লীগের নামে ও পরিচয়ে দেশব্যাপী যে একটি শক্তিশালী অপরাধী চক্র গড়ে উঠেছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। সকল পর্যায়েই আছে এদের প্রভাব এবং দাপট । চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, তদবিরসহ নানা অন্যায় কাজে জড়িয়ে এই চক্রের সদস্যরা বিপুল বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হয়েছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে যারা অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন, তাদের অনেকেই এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। সাধারণ মানুষ এসব দেখছে এবং ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে।

সাবেক মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন,‘বিএনপি-জামায়াতের চেয়েও ভয়ংকর এখন নব্য আওয়ামী লীগাররা। এসব দুর্বৃত্ত ও সুবিধাভোগীর কারণে আওয়ামী লীগের বড় বড় অনেক নেতাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সুবিধাভোগীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। না হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সব অর্জন ধুলায় মিশে যাবে’।

মোহাম্মদ নাসিম আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা। তার বক্তব্যকে পুরো সত্য বলে ধরে নিতে মন সায় দেয় না। কারণ সব অন্যায়ের দায় নব্য আওয়ামী লীগারদের ওপর চাপানোর মধ্যেও একটি সূক্ষ্ম চাতুর্য আছে। এটা অনেকটা ‘যতো দোষ, নন্দ ঘোষ'-টাইপের কথা। প্রথম প্রশ্ন, নব্য আওয়ামী লীগাররা সুবিধা গ্রহণের সুযোগ পায় কি করে? পুরনোদের হাত ধরেই তো তারা দলে ঢোকে। সমাজে ভালো মানুষ বলে পরিচিত কেউ আওয়ামী লীগে যোগ দিলে তাকে পদ-পদবি দিতে যথেষ্ট গড়িমসি দেখা যায়। অথচ যারা সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী তারা ঠিকই জায়গা পায়। দ্বিতীয় প্রশ্ন, পুরনো আওয়ামী লীগাররা কি সব ধোয়া তুলসীপাতা? দল ক্ষমতায় আসার আগে কার কি পরিমাণ সম্পদ ছিল, আর এখন কি হারে সেটা বেড়েছে, তা কিন্তু মানুষ সাদা চোখেই দেখতে পাচ্ছে। সম্পদ লুকানো কঠিন। টাকার গরম না দেখিয়ে থাকতে পারা মানুষের সংখ্যাও কম।

Advertisement

শেখ হাসিনার সব অর্জন ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার অসাধু ও অশুভ প্রতিযোগিতায় কেবল নব্য আওয়ামী লীগাররা নেই, এই দলে পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগ করেন বা পুরনো আওয়ামী লীগারও খু্ঁজে পেতে কষ্ট হবে না। আওয়ামী লীগের ক্ষতি শুধু নবাগত বা বহিরাগতদের দিয়ে হয়নি। খোন্দকার মোশতাক আহমেদ কিন্তু নব্য আওয়ামী লীগার ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি থাকতেন। মোশতাক যে ষড়যন্ত্রকারী সেটা বঙ্গবন্ধুও জানতেন। কিন্তু দয়াপরবশ হয়ে কোনো ব্যবস্থা নেননি। বন্ধু হিসেবেই দেখেছেন। কিন্তু মোশতাক বন্ধুত্বের মর্যাদা দেয়নি। সাপের স্বভাব ছোবল মারা। মোশতাক ছিলেন সাপস্বভাবের মানুষ। আওয়ামী লীগ বিষধর মোশতাকের দোসরমুক্ত হয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই । বিএনপি-জামায়াত এবং নব্য আওয়ামী লীগারদের চেয়ে মোশতাকের দোসররাও কম ভয়ংকর নয়। শত্রু-মিত্র চিনতে ভুল করলে চরম খেসারত দিতে হবে।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এইচআর/জেআইএম