গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ব্যস্ততম এলাকা আনসার রোড। মহাসড়কের উভয় দিক থেকে ছুটে আসছে বাস, ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ডভ্যান ও প্রাইভেটকারসহ অসংখ্য যানবাহন। এরই মধ্যে ছুটির ঘণ্টা বাজল মহাসড়কের পাশের আবেদ আলী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের।
Advertisement
কলেজ ছুটির পরপরই মহাসড়কের পশ্চিম পাশে জড়ো হতে শুরু করে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কলেজের কর্মচারী মতিউর রহমান লাল নিশানা হাতে মহাসড়কের যানবাহনগুলো থামানোর নির্দেশ দিচ্ছেন। ব্যস্ততম মহাসড়কে মতিউরের নির্দেশের দিকে লক্ষ্য নেই চালকদের। এরই মধ্যে যানবাহনের সংখ্যা কমলে মহাসড়ক পার হয় প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী। এই যাত্রায় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলেও হঠাৎ যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।
সোমবার (০২ মার্চ) দুপুরের দৃশ্য এটি। এভাবে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ঘিরে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ শতাধিক শিল্প-কারখানা। প্রতিদিন এসব কারখানার শ্রমিক ও বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পার হয় চার লেনের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক। মহাসড়ক পারাপারে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা কিংবা ফুটওভার ব্রিজ না থাকায় অনিরাপদ হয়ে পড়েছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক। ঝুঁকি নিয়ে পার হতে গিয়ে প্রাণহানিসহ প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা।
গাজীপুর সড়ক বিভাগের তথ্যমতে, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চার লেনের গাজীপুর অংশে শ্রীপুরের জৈনা বাজার থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার সড়ক। মহাসড়কের উভয় পাশে রয়েছে প্রায় শতাধিক শিল্প-কারখানা, বাজার ও কয়েকটি বিদ্যালয়। কারখানার শ্রমিক, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে প্রতিদিনই জীবনের ঝুঁকিয়ে নিয়ে পার হতে হয় চার লেনের মহাসড়ক। ফুটওভার ব্রিজ না থাকায় হেঁটে মহাসড়ক পার হতে গিয়ে অনেকেই পড়েন দুর্ঘটনায়। সকাল, দুপুর ও রাতে পথচারীদের মহাসড়ক পার হওয়ার সময় যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।
Advertisement
স্থানীয়রা জানায়, বর্তমান সরকার যোগাযোগব্যবস্থা সহজতর করতে এই মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার পর যেমন বেড়েছে যানবাহন চলাচলের চাপ তেমনি বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। সড়ক আইন ও পারাপারের নিয়ম সম্পর্কে কারখানার শ্রমিকরা সচেতন না থাকায় যত্রতত্র পারাপারে দুর্ঘটনায় পড়তে হয় তাদের। কয়েকটি বিদ্যালয় ও কারখানা কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মহাসড়ক পারাপারে নিরাপত্তা কর্মীর ব্যবস্থা করলেও অন্যান্য সময় শিক্ষার্থী ও শ্রমিকদের অসচেতনায় ঘটছে প্রাণহানিসহ ছোট-বড় দুর্ঘটনা।
মহাসড়ক ঘেঁষে গড়ে ওঠা জেলার অন্যতম একটি বিদ্যালয় আবেদ আলী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অবস্থান আনসার রোড এলাকায়। এই কলেজের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে আব্দুল মালেক মাস্টার কিন্ডারগার্টেনসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে প্রায় এক হাজার চারশ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। প্রতিদিন শিক্ষার্থীরা ঝুঁকি নিয়ে মহাসড়ক পার হয়।
আবেদ আলী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মতিউর রহমান বলেন, ফুটওভার ব্রিজ না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক পার হয়। বিদ্যালয় আসার সময় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হয় না। তবে বিদ্যালয় ছুটির পর শিক্ষক ও কর্মচারীরা মিলে শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক পার করে দেয়।
এদিকে প্রতিদিন একই অবস্থার মুখোমুখি হতে হয় মহাসড়কের এমসি বাজারের হাজী ছোট কলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল হান্নান সজল বলেন, বিদ্যালয় ও আশপাশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে প্রায় চার হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মহাসড়ক পার হয়। বিভিন্ন সময় ঝুঁকি নিয়ে মহাসড়ক পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনায় কয়েকজন শিক্ষার্থী আহতও হয়েছে।
Advertisement
মাওনা হাইওয়ে থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ব্যস্ততম এই মহাসড়কে যাত্রী পারাপারের কোনো ব্যবস্থা নেই। সাধারণ লোকজন অসচেতন অবস্থায় চারলেনের মহাসড়ক পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। প্রতিনিয়ত প্রানহানির ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যেই সিংহভাগই কারখানার শ্রমিক। শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা ও সড়ক পারাপারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে কারখানা কর্তৃপক্ষকেই। কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সড়ক পারাপারের সচেতনতা তৈরি করলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।
এই মহাসড়কে চলাচলকারী ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়াগামী ‘আলম এশিয়া’ পরিবহনের চালক আনিসুর রহমান বলেন, মহাসড়কটি চারলেনে উন্নীত করার পরও সুফল পাচ্ছি না। কারখানার শ্রমিকরা সকাল, দুপুর ও রাতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে মহাসড়ক পার হয়। যত্রতত্র পারাপারে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। বিভিন্ন কারখানার সামনে গাড়ি থামিয়ে শ্রমিকদের পার হওয়ার সময় দিতে হয়। ফলে যানজটের সৃষ্টি হয়। শ্রমিকদের অসচেতনতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব গণি মিয়া বাবুল বলেন, পৃথিবীর কোথাও সড়ক ঘেঁষে শিল্পকারখানা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার নজির নেই। ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। এরপরও মহাসড়ক ঘেঁষে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠায় শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলাচলে মহাসড়ক প্রতিনিয়ত অনিরাপদ হয়ে উঠছে। দুর্ঘটনা কমানোর লক্ষ্যে স্বল্পকালীন হিসেবে শ্রমিকদের মধ্যে মহাসড়ক পারাপারে সচেতনতা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। কারখানা কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে তাদের মধ্যে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। জনগুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পারাপারের জন্য কিছু সংখ্যক ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে।
এ বিষয়ে গাজীপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাইফুদ্দিন বলেন, মহাসড়ক ও যাত্রীদের চলাচলে নিরাপত্তা তৈরিতে সচেষ্ট সরকার। এ বিষয়ে পরিবহন চালক ও যাত্রীদের সচেতনতার বিকল্প নেই। এই মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে কয়েকটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখা হবে।
এএম/এমকেএইচ