ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ঘিরে দেশটির রাজধানী নয়াদিল্লি এখন রক্তস্নাত। মুসলিমবিদ্বেষী হিংসার দাবানলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দিল্লির শিব বিহার এলাকায় এখনও বিরাজ করছে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। উন্মত্ত উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সোমবারের হামলার কথা মনে করে এখন ডুকরে কেঁদে উঠছেন ৬০ বছর বয়সী বিলকিস বানু।
Advertisement
আক্রমণকারীরা যখন তেড়ে আসে, সেই সময় তিনি বাড়ির ভেতরেই ছিলেন। প্রায় ৩৫ বছর ধরে ওই বাড়িতেই থাকেন বিলকিস বানু। দোতলা বাড়ির নিচতলার একটি কক্ষে ছিল তাদের দোকান।
সেদিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে এই বৃদ্ধা বলেন, ‘আগুনে সব কিছু জ্বলছিল, সব কিছু...। আমি প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে পালাতে যাই... তবে পড়ে গিয়েছিলাম। উন্মত্ত জনতা আমাকে ধরে ফেলেছিল। হামলাকারীরা সর্বত্র দৌড়ে বেড়াচ্ছিল। বাড়িঘর, দোকানপাটে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল। আমি হামাগুঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে পালাতে যাই। আমার বড় ছেলে মোহাম্মদ ইউসুফ (৪২) আমাকে খুঁজে পায়। তারপর ভিড়ের বাইরে টেনে নিয়ে আসে। পরে আমরা একটি নিরাপদ স্থানের দিকে ছুটে পালাই।’
বিলকিস বানুর দোতলা বাড়ি এবং দোকান ছাই হয়ে গেছে দাঙ্গাবাজদের আগুনে। দুই ছেলে এবং পুত্রবধূদের সঙ্গে নিয়ে হামলার পর পাশের একটি মাজারে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
Advertisement
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের পক্ষে ও বিপক্ষের মানুষের মধ্যে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে যে ভয়াবহ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিব বিহার। এই সহিংসতায় রোববার পর্যন্ত ৪৬ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন। এখনও শতাধিক মানুষ আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, উন্মত্ত জনতা সবকিছু তছনছ করে দেয়। চোখের সামনে যা ছিল তাতেই আগুন লাগিয়ে দেয় তারা। কয়েকশ পরিবার এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। শনিবার বিলকিস বানু যখন এনডিটিভির প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছেন, তখনও তার পরনে ছিল গত সোমবারের পোশাক।
বিলকিস বানুর ছেলে ইউসুফ বলেন, আমি এই যে শার্টটা পরে আছি... মিনিট খানেক আগে আমি প্রতিবেশীর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি।
পাশেই যমুনা বিহার অঞ্চল। ৩৩ বছর বয়সী প্রীতি গর্গের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। সেই দিনগুলোর কথা তুলতেই মনে পড়ে যাচ্ছে, দাঙ্গাবাজরা কীভাবে তার বাড়িতে আগুন দিয়েছে। তার ৫ এবং ৯ বছরের দুই ছেলে জীবন বাঁচাতে একতলা থেকে ঝাঁপ দেয়।
Advertisement
প্রীতি বলেন, ‘সোমবার বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চলে। পাথর ছোঁড়া দিয়ে শুরু হয়েছিল, পরে তারা আগুন লাগিয়ে দেয়। আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে একটি পেট্রোল পাম্প জ্বালিয়ে দেয়। হামলাকারীরা আমাদের বাড়ির সামনের অংশেও আগুন ধরিয়ে দেয়। নিচতলা সেই সময় খালি, আগুনের শিখা দাউ দাউ করে ওপরে উঠতে থাকে। আমার ছেলেরা এবং আমি একতলায় ছিলাম, সঙ্গে ছিল আমার স্বামী এবং শাশুড়ি। আমরা বাচ্চাদের প্রথমে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিই।’
‘আমরা বারান্দা থেকে বাচ্চাদের হাত ধরে ওদের নিচে নামাই। তারপর ওদের নিচে লাফ দিতে বলি। আমার জীবনের অন্যতম ভয়ানক মুহূর্ত ছিল সেটি। বাচ্চাদের বাঁচানোর পর আমরা বাকিরা ছাদে চলে যাই, সেখান থেকে প্রতিবেশীর ছাদে যাই।’
সাম্প্রদায়িকতার আগুনে প্রীতির বাড়ির নিচতলা ছাই হয়েছে। তার শাশুড়ি সন্তোষ বলেন, ‘যখনই আমি বারান্দায় যাচ্ছি, মনে পড়ছে আমার নাতি-নাতনিরা আগুন থেকে বাঁচতে একতলা থেকে ঝাঁপ দিচ্ছে....সব মনে পড়ে যাচ্ছে।’
এসআইএস/পিআর