মতামত

সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার মুশফিকের

ক্রিকেট মহলের বড় একটা অংশ সংশয়দীর্ণ। সেটা মুশফিকুর রহিমকে নিয়ে। সেই দলে রয়েছেন বিসিবি সভাপতি থেকে সাধারণ মানুষ।কেন মুশফিক পাকিস্তান সফরে গেলেন না এবং যেতে চাচ্ছেন না! বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানকে স্কোয়াডে পেতে চাইবেন অধিনায়ক। এটা স্বাভাবিক। অধিনায়ক মুমিনুল হকও চান দারুণ ফর্মে থাকা মুশি পাকিস্তান সফরের শেষ পর্বে দলের সঙ্গে থাকুন। কিন্তু বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক তার নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। আপাতত সেটাই খবর।

Advertisement

তবে সেই খবরকে ছাপিয়ে একটু বড় খবর হয়ে দাঁড়াল বোর্ড সভাপতির একটা মন্তব্য। ‘ওর (মুশফিক) পরিবারের সদস্যরা পাকিস্তান সফর করে এসেছে। ওর অসুবিধা কোথায়?’ মুশফিক স্পষ্ট করে বলেননি তার অসুবিধা কোথায়। তবে বাংলাদেশ কেন, ক্রিকেট বিশ্বের কারও বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়, নিরাপত্তার কারণেই তিনি পাকিস্তান সফরে যাননি এবং যেতে চান না।

প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হিংসা-সন্ত্রাসের সামনে দাঁড়াতে না চাওয়ার অধিকার সাধারণ মানুষের আছে। একজন ক্রিকেটারেরও আছে। মুশফিক বোর্ডের চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটার। সেটা সত্যি। তবে চুক্তির ভেতর কোনো ধারায় লেখা নেই, বোর্ড বললে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে সীমান্ত পাহারা দিতে হবে। না দিলে তার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে!

বাংলাদেশ ক্রিকেটে মুশফিক অনেক বড় পারফরমার। তবে নিশ্চিত করে বলা যায়; বড় তারকা তিনি নন। আর তারকা ইমেজ বিক্রি করে তিনি আজকের এই পর্যায়ে আসেননি। তার স্টারডম না থাকলেও অন্য অনেকের চেয়ে ব্যতিক্রমী কিছু গুণ আছে। আজকের সমাজে হয়তো সেটা আপাত মূল্যহীন। কিন্তু আগামী প্রজন্মের কাছে তিনি আরও অনেক কারণে অনুকরণীয় হয়ে থাকতে পারেন। থাকবেন কি থাকবেন না সেটা সময় বলে দেবে।

Advertisement

মুশফিকুর রহিম। বাংলাদেশ ক্রিকেটে ওজনদার এক নাম। সেই নামের ক্রিকেটীয় কৌলিন্য আছে। শিক্ষা আছে। কিন্তু নেই গর্ব। নেই রাজনৈতিক শক্তি। আছে কেবল পারফরম্যান্স। আছে মানবিকতা নামের দুর্লভ বস্তুটি। বিদ্বেষের অন্ধকারে সেই আলো কম দেখা যায়। যে কারণে হুটহাট করে তাকে পরোক্ষ হুমকির সুরে বিদ্বেষ ছড়ানো মন্তব্য করা যায়। বলা যায়- ‘ওর পরিবারের সদস্য পাকিস্তানে যেতে পারলে ওর সমস্যা কী!’

প্রত্যেকটা ব্যক্তির স্বকীয়তা থাকে। নিজস্ব চিন্তার জগৎ থাকে। সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার থাকে। কারও পরিবারে ভালো-সৎ-পরিচ্ছন্ন ইমেজের একজন রাজনীতিবিদ আছেন। তার অর্থ এই নয়, যে পরিবারের সবাই সে রকমভাবেই চলছেন। সেই পথকেই পাথেয় করেছেন। পাকিস্তান অনেকের কাছে ভালো লাগার জায়গা হতেই পারে। আবার কারও কাছে ভয়ভীতি, আতঙ্কিত এক জনপদ। সুতরাং সেই জনপদে কেউ যাবেন কি যাবেন না, সেই সিদ্ধান্তটা তাকেই নিতে দেয়া উচিত।

সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো জ্ঞান, বোধ-বুদ্ধি সবই আছে মুশফিকের। বরং তার না যাওয়া নিয়ে যা কিছু শব্দ খরচ করা হচ্ছে সেটা পরোক্ষভাবে লোকটার আবেগ-অনুভূতিকে আঘাত করা। সেই আঘাত না করে বরং তার অন্তরের অনুভূতিটা অনুভব করার চেষ্টাই ভালো। এই অনুভব করার ক্ষমতাই নৈতিকতার ভিত্তি, যাহা বুদ্ধিমান জীবকে ‘মানুষ’ করে তোলে। এটাই মানুষের বড় সম্পদ। তবে সবার দ্বারা সেই সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করা কঠিন।

গেল প্রায় এক দশক সন্ত্রাস, রক্তপাতের কারণে পাকিস্তানের মাটিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নির্বাসিত ছিল। তারপরও কি সেখানে বীভৎসতার খবর কম ছাপা হয়েছে গণমাধ্যমে। এমনকি পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরতে শুরু করার পরও কি সেসব ঘটনা চাপা পড়েছে! পাকিস্তান কেন, এই উপমহাদেশে এই মুহূর্তে যা অবস্থা তাতে কেউ জোর গলায় বলতে পারছেন না, এখানে আপনার জীবন বিপন্ন নয়। ‘আমি থাকিতে তোমার ভয় নাই।’

Advertisement

বহু ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞ বলেন, মুশফিক হচ্ছেন এই মুহূর্তে বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং মেরুদণ্ড। তাকে ছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেটের ব্যাটিং লাইনের অবস্থা নড়বড়ে। এটা সত্যি কথা। উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান হলেও এখন তাকে খুলে রাখতে হচ্ছে কিপিং গ্লাভস। বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানের মতো সর্বদা বড় রানের ইনিংস দাবি করা হয় তার ব্যাট থেকে। সেটা গ্লাভস হাতে কিংবা গ্লাভস খুলে রেখে শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবেও করে যাচ্ছেন। যে কারণে তার কাছে প্রত্যাশাও বেশি। তবে এর অর্থ এই নয়- তার ওপর মানসিক চাপ তৈরি করে হলেও পাকিস্তান সফরে যেতে বাধ্য করতে হবে।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি করার পর, তাকে নিয়ে আলোচনাটা আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। কেন তিনি পাকিস্তান যাবেন না! সেই আওয়াজটা যাতে জোরালো হয় তেমন ‘হুইসেল’ বাজিয়ে দেয়া হয়েছে। সেটা খোদ বোর্ড থেকে। তবে বুঝি না, অজস্র অপযুক্তি কেন বারে বারে বাঙালিদের দিকেই ধেয়ে আসে। কেন সেই যুক্তি নিজের মস্তিষ্ক দিয়ে প্রয়োগ করতে চান তারা!

লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।

এইচআর/বিএ/জেআইএম