ধর্ম

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গ্র্যান্ড ইমামদের পরামর্শ

বিশ্বজুড়ে ৫৪টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে নভেল করোনাভাইরাস। আগের তুলনায় চীনে আক্রান্তের ধারা কিছুটা কমলেও বেড়েছে অন্যান্য দেশগুলোতে। ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইরানের অবস্থা ভয়াবহ। ইরানের গ্র্যান্ড মুজতাহিদগণ করনোভাইরাস প্রতিরোধে ধর্মীয় ও স্বাস্থ্যবিষয়ক দিক-নির্দেশনামূলক তথ্য তুলে ধরেছেন।

Advertisement

ইরানের গ্র্যান্ড মুজতাহিদ আয়াতুল্লাহ সোবহানী, আয়াতুল্লাহ নাসের মাকারেম শিরাজি, আয়াতুল্লাহ ওয়াহিদ খোরাসানী এবং আয়াতুল্লাহ শোবেইর যানজানি প্রমুখ করোনাভাইরাস প্রতিরোধের জন্য মহান আল্লাহর উপর ভরসা এবং ইমামদের শরণাপন্ন হয়ে ধৈর্য সহকারে স্বাস্থ্য টিপস মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।

ইরানের করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়ে চলছে। এ ভাইরাস সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাব ইরানের শীর্ষস্থানীয় আলেম আয়াতুল্লাহ শোবেইর যানজানি বলেন, ‘এই ভাইরাসের মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। এজন্য সকলকেই স্বাস্থ্যবিধি এবং চিকিৎসকরে পরামর্শ মান্য করতে হবে।’

দেশটির শীর্ষস্থানীয় গ্র্যান্ড মুজতাহিদরা অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন। তারা সে সবের উত্তর দিয়েছেন। প্রশ্ন ও উত্তরগুলো তুলে ধরা হলো-

Advertisement

>> চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ থাকা সত্ত্বেও সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত সন্দেহভাজন ব্যক্তি যদি এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ না করে জনসাধারণের মধ্যে প্রবেশ করে তাহলে তার বিধান কী? শরীয়তগত ভাবে চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞদের এই পরামর্শ মান্য করা কী জরুরী? বিশেষত, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ থাকা সত্ত্বেও কিছু ব্যক্তি ক্লাস, ধর্মীয় ও অ-ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং সমাবেশ বন্ধ করার বিষয়টা সঠিক বলে মনে করছেন না। শরীয়তের দৃষ্টিতে তাদের এধরণের কাজ কী বৈধ?

>> আয়াতুল্লাহ শোবেইর যানজানির উত্তর-করোনাভাইরাসের মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। এজন্য সকলকেই স্বাস্থ্যবিধি এবং চিকিৎসকরে পরামর্শ মান্য করতে হবে। এই রোগের বিস্তার রোধ করতে কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে এবং এ ব্যাপারে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমরা আশা করি যে, আমাদের দেশের প্রিয় জনগণ সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর নির্ভর করে এবং ইমামদের শরণাপন্ন হলে এই ভয়ঙ্কর রোগ প্রতিরোধ করতে পারবে।

>> আয়াতুল্লাহ ওয়াহিদ খোরাসানী পরামর্শআয়াতুল্লাহ ওয়াহিদ খোরাসানী করোনাভাইরাসের উদ্বেগজনক অবস্থায় জনগণের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নির্দেশনাবলী অনুসরণ করার পাশাপাশি প্রতিদিন আপনাদের হৃদয়ে (বুকে) হাত রাখুন এবং সাতবার সুরা হামদ (ফাতেহা) পড়ুন।’

তিনি আরও নসিহত করেছেন যে, ‘আপনাদের হাতকে বুকের উপর রেখে প্রতিদিন সকাল ও রাতে সাতবার আয়াতুল কুরসি وَ هُوَ الْعَلِیُّ الْعَظِیمُ (ওয়া হুয়াল আলিউল আযীম) পর্যন্ত পাঠ করুন।

Advertisement

>> আয়াতুল্লাহ নাসের মাকারেম শিরাজি নসিহতএক ভিডিও বার্তায় করনোভাইরাস প্রতিরোধে জনগণকে আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখতে বলেছেন আয়াতুল্লাহ নাসের মাকারেম শিরাজি। তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের ব্যাপারে জনগণকে ভয় এবং বিচলিত হলে চলবে না। মহান আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হবে।’তিনি আরও বলেন, ‘সব বাড়িতে জিয়ারত-এ-আশুরা এবং হাদিসের দরস পাঠ করা উত্তম। কারণ এ দরসের মাধ্যমে মানুষর আত্মিক শান্তি বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি স্বাস্থবিধিসমূহ গুরুত্ব সহকারে পালন করতে হবে এবং সাধারণ সভা ও ভিড়ের মধ্যে উপস্থিতি পরিহার করতে হবে।

মনে রাখতে হবে-প্রতিটি মানুষের জন্য জীবন রক্ষা করা ফরজ। আর যদি কেউ এই বিষয়টি ছোট করে দেখে তাহলে তিনি আল্লাহর কাছে দায়বদ্ধ হয়ে থাকবেন।

আয়াতুল্লাহ নাসের মাকারেম শিরাজি এ বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘‘এ বিষয়ে মানুষকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। চিকিৎসকদের নির্দেশাবলী ও স্বাস্থ্যবিধি পালন করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। জনসাধারণের মধ্যে কম উপস্থিত হতে হবে এবং মহান আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ! এই রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে দোয়াসমূহ, জিয়ারত-এ-আশুরা এবং হাদিসের দারস বিশেষ প্রভাব সৃষ্টি করবে। আমরাও দোয়া করবো।’তবে শর্ত হচ্ছে, জনগণের উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্তৃপক্ষ যে নির্দেশনাবলী দিয়েছেন তার প্রতি মনোযোগী হতে হবে এবং সেগুলো গুরুত্ব সহকারে পালন করতে হবে।

>> আয়াতুল্লাহ জাফর সোবহানীর নসিহতকরোনাভাইরাস প্রতিরোধে আয়াতুল্লাহ জাফর সোবহানীর নসিহত হলো, প্রথমত চিকিৎসকদের পরামর্শ ন্যায়সঙ্গতভাবে মেনে চলতে হবে।

ইরানের কয়েকটি শহরে করোনারি হার্ট ডিজিজের প্রাদুর্ভাব ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। মহাবিশ্বে যা কিছুই ঘটুক না কেন মহান আল্লাহ সেগুলো সুসংহত রেখেছেন এবং এই বিষয়ে আমরা অবগত নই। সব সময় মহান আল্লাহর প্রতি মনোযোগী হতে হবে এবং জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ তায়ালা সব সময় তাঁর বান্দাদের প্রতি ক্ষমাপরায়ণ ও করুণাময় থাকেন। নসিহতস্বরূপ তিনি কুরআনের কথা তুলে ধরেন-‘অনন্তর তাঁরই দিকে তোমাদের ফিরে যেতে হবে। অতপর তোমাদেরকে বলে দিবেন, যা কিছু তোমরা করছিলে। তিনিই স্বীয় বান্দাদের উপর প্রবল। তিনি প্রেরণ করেন তোমাদের কাছে রক্ষণাবেক্ষণকারী। এমন কি, যখন তোমাদের কারও মৃত্যু আসে তখন আমার প্রেরিত ফেরেশতারা তার আত্মা হস্তগত করে নেয়। আর তারা সামান্যতম অবহেলাও করে না।’ (সুরা আনআম : আয়াত ৬১)

এ বান্দাকে রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্তির ব্যাপারটি উঠে এসেছে। এসব রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত ফেরেশতারা মানুষের নানা রোগ-ব্যাধি, বালা-মুসিবত বা দুর্যোগ থেকে রক্ষার নিয়োজিত। সে কারণে আল্লাহর কাছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া থেকে আত্মরক্ষায় সাহায্য কামনা করা জরুরি। আল্লাহর সাহায্যেই এ ভাইরাস থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। আগে ও পরে আল্লাহর সাহায্য লাভের মাধ্যমে এ রকম বহু মারাত্মক মরণব্যাধি থেকে মুক্তির বহু নজির রয়েছে।

আয়াতুল্লাহ সোবহানী চিকিৎসকদের পরামর্শ যথাযথ মেনে চলতে পরামর্শ দিয়েছেন। চিকিৎসকগণ বলেছেন, ‘জনসম্মুখে কম উপস্থিত হতে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে, তাদের নির্দেশ সবারই পালন করতে হবে। নিঃসন্দেহ সর্বশক্তিমান স্রাষ্টার করুণা সকলের উপর বর্তাবে।

এ রোগ থেকে বেঁচে থাকতে ধর্মীয় অনুশাসনের মেনে চলার পাশাপাশি বিশ্বনবির শেখানো দোয়ার মাধ্যমে এ ভাইরাস থেকে আত্মরক্ষায় দোয়া করাও জরুরি। মহামারী আক্রান্ত অঞ্চলের মানুষকে এ দোয়া পড়তে বলেছেন বিশ্বনবি। আর তাহলো-اَللَّهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَ الْجُنُوْنِ وَ الْجُذَامِ وَمِنْ سَىِّءِ الْاَسْقَامِউচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাচি ওয়াল জুনুন ওয়াল ঝুজাম ওয়া মিন সায়্যিল আসক্বাম।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনার কাছে আমি শ্বেত রোগ থেকে আশ্রয় চাই। মাতাল হয়ে যাওয়া থেকে আশ্রয় চাই। কুষ্ঠু রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে আশ্রয় চাই। আর দূরারোগ্য ব্যাধি (যেগুলোর নাম জানিনা) থেকে আপনার আশ্রয় চাই।’

হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ তিরমিজিতে আরও একটি দোয়া উল্লেখ করাহয়েছে। যা পড়তে বলেছেন বিশ্বনবি-اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الأَخْلاَقِ وَالأَعْمَالِ وَالأَهْوَاءِ وَ الْاَدْوَاءِউচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন মুনকারাতিল আখলাক্বি ওয়াল আ’মালি ওয়াল আহওয়ায়ি, ওয়াল আদওয়ায়ি।’অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার কাছে খারাপ (নষ্ট-বাজে) চরিত্র, অন্যায় কাজ ও কুপ্রবৃত্তির অনিষ্টতা এবং বাজে অসুস্থতা ও নতুন সৃষ্ট রোগ বালাই থেকে আশ্রয় চাই।’ (তিরমিজি)

উল্লেখ্য যে, হুবেই প্রদেশে দেখা দেয়া এ ব্যাধিতে শুধু চীনেই আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৯ হাজার ২৫১ জন। মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯২২ জন। চীনা কর্মকর্তাদের তথ্য মতে, ‘এখন পর্যন্ত তারা এ ভাইরাসে আক্রান্ত ৩৯ হাজার ২ জনকে তারা চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলেছেন।

এমএমএস/এমকেএইচ