আন্তর্জাতিক

ট্রাম্প-মোদির ভালোবাসায় কার কী লাভ?

প্রথমবারের মতো ভারত সফরে এক কোটি মানুষের অভ্যর্থনা আশা করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই আশা পুরোপুরি পূরণ হয়নি, তবে যা পেয়েছেন তাও কম নয়। ট্রাম্প আমেরিকানদে দেখাতে চাচ্ছিলেন, বিদেশেও তার বিপুল জনপ্রিয়তা রয়েছে এবং লোকে ‘কিং অব ট্যারিফ’ (শুল্কের রাজা) বললেও তিনি অন্য দেশের সঙ্গেও ভালো চুক্তি করতে পারেন।

Advertisement

ট্রাম্পের এই সফর গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইমেজ সংকটে ভুগতে থাকা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্যেও। বেশ কিছুদিন ধরেই কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল ও বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের কারণে বারবার নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হচ্ছিলেন তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, সফরকালে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখে ব্যাপক গুণকীর্তন মোদিকে সেই সংকট থেকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।

তবে এতকিছুর মধ্যেও অপূর্ণই থেকে গেছে দুই দেশের মধ্যে বহুল প্রত্যাশিত বাণিজ্য চুক্তির সাধ। ধুম-ধাড়াক্কা নাচগান আর জমকালো অনুষ্ঠানের বাইরে কী পেল ভারত-যুক্তরাষ্ট্র, চলুন দেখে নেয়া যাক।

জনতার সুদৃষ্টিট্রাম্পের ভারত সফরের প্রথমদিন গেছে মূলত জনগণের সুদৃষ্টি পাওয়ার চেষ্টায়। তা পেয়েছেনও যথেষ্ট। আহমেদাবাদ বিমানবন্দর থেকে শুরু করে গুজরাটের মোটেরা ক্রিকেট স্টেডিয়াম পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে।

Advertisement

স্টেডিয়ামেও তাকে উজ্জীবিত রাখতে উপস্থিত ছিল লাখো জনতা। তাদের সামনে বক্তব্যে অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে বলিউড তারকা, ক্রিকেটারসহ গুণী ব্যক্তিদের নাম নিয়েছেন ট্রাম্প, যা সহজেই ভারতীয়দের মনে দাগ কাটে।

ওই বক্তব্য শুধু ভারতীয়দের মন জয়ের জন্যই নয়, কাজে এসেছে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণাতেও। ‘নমস্তে ট্রাম্প’-এর ভিডিও এরই মধ্যে প্রচারণায় ব্যবহার শুরু করেছে তার রিপাবলিকান পার্টি।

এছাড়া বক্তব্যে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদির প্রশংসার বন্যা বইয়ে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এটি মোদিকে ইমেজ সংকট কাটাতে সাহায্য করবে বলে মনে করেন ব্রুকলিন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো তানভি মদন।

তিনি বলেন, ট্রাম্প তাকে (মোদি) খুবই শান্তশিষ্ট, চমৎকার নেতা এবং এমন একজন ব্যক্তি বলে বর্ণনা করেছেন যিনি জনগণের জন্য কাজ করেন। মোদি অবশ্যই এসব স্তুতিবাক্য সানন্দেই গ্রহণ করবেন।

Advertisement

দিল্লিতে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন প্রাণ হারিয়েছেন, আগুন জ্বলছে গোটা রাজ্যে, প্রশ্ন উঠছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্ব নিয়েও- এমন সময় ট্রাম্পের অমন প্রশংসাবাণী অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।

পূরণ হয়নি যে আশাগত কয়েকবছর ধরেই শুল্ক লড়াইয়ের জেরে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের। এ সংকট কাটাতে একটি বাণিজ্য চুক্তি অত্যন্ত জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। ট্রাম্পের আশা, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে ভারসাম্য আনবে এই চুক্তি। এ কারণে সফরের আগে থেকেই সবার নজর ছিল বহুল প্রত্যাশিত এই বাণিজ্য চুক্তির দিকে। কিন্তু এবারও সেই আশা পূরণ হলো না।

তবে তানভি মদনের মতে, এই চুক্তির সম্ভাবনা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। তিনি বলেন, এই সফর অন্ততপক্ষে ভারতকে ট্রাম্প প্রশাসনের ‘হিট লিস্ট’-এর নিচে নামিয়ে আনবে। কারণ বাণিজ্য চুক্তির জন্য আলোচনা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

এ বিশ্লেষক বলেন, আপনি প্রতিবার একেকটি পারমাণবিক চুক্তি আশা করতে পারেন না। সেদিক থেকে এবারের সফর বেশ সফলই হয়েছে।

বাণিজ্য বিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কন্ট্রোল রিস্ক কনসালটেন্সির সহকারী পরিচালক প্রত্যুষ রাও বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। ধারণা করা হয়, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কিছু সময়ের জন্য হালকা হয়ে পড়েছিল। ট্রাম্প প্রশাসনেও ভারতের অংশীদারিত্বের অভাব রয়েছে। সেক্ষেত্রে সম্পর্কোন্নয়নে রাষ্ট্রপতি সফরের চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না।

যে চুক্তি হলোডোনাল্ড ট্রাম্প চুক্তি করা পছন্দ করেন। আর এবারও ঘরে ফেরার সময় এ ধরনের কয়েকটি সুখবর সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তিন বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সামরিক হেলিকপ্টার ও যুদ্ধ সরঞ্জাম কিনছে। আরেকটি চুক্তি হয়েছে এক্সন মোবিলের সঙ্গে। এই চুক্তি অনুসারে ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করবে।

প্রত্যুষ রাও বলেন, প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ভারতকে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া তারা পেট্রোলিয়াম আমদানির ক্ষেত্রেও বৈচিত্র আনতে চাচ্ছিল। সেক্ষেত্রে এই চুক্তি চলে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি হলেও ভারত মূলত (৫০ শতাংশ) সামরিক সরঞ্জাম কেনে রাশিয়া থেকে। সেক্ষেত্রে মস্কোকে হাতে রেখে প্রতিরক্ষা-পোর্টফোলিওতে বৈচিত্র্য আনলে তাদের কোনও ক্ষতি নেই।

চীনবিরোধী মতৈক্যভারত সফরের বক্তৃতায় সরাসরি চীনের নাম না নিলেও বেশ কয়েকবারই তাদের সমালোচনা করে খোঁচা দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি একাধিকবার চীনা প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের ৫জি কার্যক্রমের ওপর ওয়াশিংটনের সন্দেহের বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন।

ট্রাম্প বলেছেন, সফরকালে আমরা একটি সুরক্ষিত ৫জি ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কের গুরুত্ব এবং এই উদীয়মান প্রযুক্তির স্বাধীনতা, অগ্রগতি, সমৃদ্ধির হাতিয়ার হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে আলোচনা করেছি।

দ্য উইলসন সেন্টারের উপ-পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের বক্তব্যে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তিনি বলেন, এই (ভারত-যুক্তরাষ্ট্র) সম্পর্কের বড় প্রভাবক চীন। আপনি একই মূল্যবোধ বা মোদি-ট্রাম্পের বন্ধুত্বের কথা বলতে পারেন। তবে যেটি সত্যিই দুই দেশকে একত্রিত করছে, তা হলো সমকেন্দ্রিক স্বার্থ।

বক্তব্যে ট্রাম্প এশিয়া প্যাসিফিক না বলে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কথা বলেছেন। কারণ, এশিয়া প্যাসিফিকের মধ্যে চীনও পড়ে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতকে নিয়ে ‘ব্লু ডট প্রকল্পের’ কথাও উল্লেখ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এ প্রকল্পের মাধ্যমে উল্লেখিত চার দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে একত্রিত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

ব্লু ডট প্রকল্পের ফলে ভারত চীনের প্রস্তাবিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) বিরোধী হয়ে ওঠার ঝুঁকি রয়েছে। যদিও এই মুহূর্তে এমন আশঙ্কার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন মাইকেল কুগেলম্যান।

কাশ্মীর ও পাকিস্তানসাধারণত ভারত সফরের সময় বিশ্বনেতারা কাশ্মীর ও পাকিস্তানের নাম নিতে চান না। তবে সে পথে হাঁটেননি ট্রাম্প। বলেছেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান থাকেন সঙ্গে তার দারুণ সম্পর্ক। এবং কাশ্মীর ইস্যুতে আবারও দুই দেশের মধ্যে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।

প্রত্যুষ রাওয়ের মতে, কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে কেউ কিছু বলা মোটেও পছন্দ নয় নরেন্দ্র মোদির। কিন্তু ট্রাম্প তার এত বেশি প্রশংসা করেছেন যে সেটাতে তিনি আর কিছু মনে করবেন না। আর ভারতীয়রাও ওটাকে (কাশ্মীর নিয়ে বক্তব্য) ছোটখাটো ভুল হিসেবেই মেনে নেবে।

তাছাড়া, ভারতে চলমান বিক্ষোভ ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়েও কোনও মন্তব্য করেননি মোদির ‘সেরা বন্ধু’ ট্রাম্প। বরং, তিনি যা করেছেন তা ছিল ধারণাও বাইরে। ভারতে সব সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা দিতে মোদির কার্যক্রমের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।সেক্ষেত্রে কাশ্মীর ও পাকিস্তান নিয়ে ট্রাম্পের বক্তব্যে কোনও ভারতীয়র মনে অস্বস্তি থাকলেও সেটা ওই প্রশংসাবাণীতেই মুছে যাওয়ার কথা।

সামনে কী হবেট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকাণ্ড কখনোই খুব একটা অনুমানযোগ্য নয়। তাদের এমন বৈশিষ্ট্যই যেকোনও সম্পর্কের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। আছে অন্য সমস্যাও।

কৌশলগত ও নিরাপত্তাজনিত কারণে ট্রাম্পকে পাশে রাখা প্রয়োজন বিজেপি সরকারের। ভারত সফরে জমকালো অভ্যর্থনায় মোদি বুঝিয়েও দিয়েছেন, এই সম্পর্ক ধরে রাখতে তিনি কতটা সচেষ্ট। কিন্তু তাদের এমন ‘মধুর সম্পর্কের’ ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে মূলত আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ওপর।

সফরকালে ট্রাম্প-মোদির ‘ব্রোম্যান্স’-এর (ভ্রাতৃত্বের ভালোবাসা) পূর্ণ প্রদর্শনী দেখা গেছে, আর এখন সেটাই দুই দেশের সম্পর্কের মূল ভিত্তি হয়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে পরিচিত নেতা ক্ষমতায় থাকলেই সুবিধা ভারতের। এখন মনে মনে তাদের একটাই প্রার্থনা, ট্রাম্পের অননুমেয় চরিত্র যেন এ সম্পর্ককে কোনও ঝামেলায় না ফেলে।

প্রত্যুষ রাও বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশাল জনসমাগম ও মনে রাখার মতো চমক চেয়েছিলেন। ভারত তাকে সেটা দিয়েছে। এখন দেখা যাক, এ চমকের প্রভাব কত দিন থাকে।

সূত্র: বিবিসি

কেএএ/এমএস