আন্তর্জাতিক

দিল্লিতে গুজরাট মডেল : টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া

নয়াদিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবন আলোকসজ্জায় সজ্জিত। ভবনের ছাদের দিকে ওপরের অংশে মার্কিন পতাকার রঙ যুক্ত করা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের সম্মানে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের আয়োজিত নৈশভোজের আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এমন আলোকসজ্জায় সেজেছিল ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন।

Advertisement

মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত সংঘাতে বিধ্বস্ত উত্তরপূর্ব দিল্লি নিয়ে প্রকাশ্যে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিংবা রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বরাত দিয়ে সরকারি এক কর্মকর্তা দেশের জনগণ এবং গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীলতার পাশাপাশি গুজব না ছড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান মঙ্গলবার রাতে একটি টুইট করেছেন। এতে তিনি বলেছেন, ভারত সরকারের একেবারে উচ্চপর্যায়ের নীরবতা নয়াদিল্লির এই সহিংসতাকে দীর্ঘ করতে ভূমিকা রাখছে। গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই সহিংসতায় দিল্লির ক্ষমতাসীনদের বধির হয়ে যাওয়াটা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক।

এই মুহূর্তে শান্ত ও ঐক্যবদ্ধ থাকার ডাক দেয়াটা জরুরি। কিন্তু কোথাও থেকে এই ডাক শোনা যাচ্ছে না।

Advertisement

ভারতের বাংলা দৈনিক গণশক্তি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ঘর পোড়া আগুনের পাকিয়ে ওঠা কুণ্ডলী, কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া আকাশ, আর্তনাদ- হাহাকারের মাঝে দিল্লিতে দাঁড়িয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার মোদিকে সার্টিফিকেট দিয়েছেন ‘স্ট্রং ম্যান’ বলে। কিন্তু সমালোচনা শুরু হয়েছে, স্ট্রং ম্যান আর তার ডেপুটি’র প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই ‘গুজরাট মডেল’ কার্যকরী হচ্ছে দিল্লিতে।

দৈনিক গণশক্তি বলছে, সাংবাদিকদের ধর্ম প্রমাণ করতে বলে আক্রমণ করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। গুলিবিদ্ধ হয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছে এক সাংবাদিক। জয় শ্রীরাম, হর হর মহাদেব স্লোগানে আকাশ কাঁপিয়ে হামলা চালানো হচ্ছে সংখ্যালঘু মুসলিমদের মসজিদে। দিল্লির অশোকনগর এলাকায় এক মিনারের মাথায় উঠে হনুমান পতাকা লাগানোর হিন্দুত্ববাদী আস্ফালনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। একটি মাজারে কীভাবে পেট্রল বোমা, আগুন দেয়া হচ্ছে অল্পবয়সীদের দিয়ে তাও সামনে এসেছে।

গণশক্তির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হচ্ছে মুসলিমদের উদ্দেশ্যে। সেই ভিডিও তুলে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, নির্ভয়ে। উন্মত্তরা যেন নিশ্চিত ভাইরাল এসব ভিডিও দেখেও পুলিশ তাদের ধরবে না। পুলিশের সামনেই হিন্দুত্ববাহিনী পাথর আনছে, পেট্রোল আনছে। ছবি, ভিডিও ছড়িয়ে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ভিডিওগুলোতে চিৎকার করে হিন্দুত্ববাদীরা বলছেন, পুলিশ আমাদের সাথে আছে।

ভারতীয় এই সংবাদমাধ্যম বলছে, গুলিবিদ্ধ যুবক ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় পড়ে রয়েছেন, অ্যাম্বুলেন্স পুলিশ আসেনি উদ্ধার করতে। মিশ্র জনবসতির এলাকায় বেছে বেছে মুসলিমদের দোকান ভাঙচুর করা হচ্ছে, আগুন লাগানো হচ্ছে। গোকলপুরীর টায়ার বাজার যেখানে মুসলিমদেরই দোকান অধিকাংশ, পুরোটাই জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।

Advertisement

‘মৌজপুর, জাফরাবাদের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দুদের বাড়ির বাইরে গেরুয়া পতাকা লাগানো হয়েছে সোমবার সকালে, যাতে নির্দিষ্ট করে মুসলিমদের বাড়িঘর চিহ্নিত করা যায় আক্রমণের জন্য। তারপরই শুরু হয় হামলা। এই সমস্ত ঘটনা থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ধনে-প্রাণে মারার এক সুপরিকল্পিত বন্দোবস্ত স্পষ্ট হয়ে গেছে।’ যারা স্মরণে রেখেছেন তারা বলছেন, অবিকল যেন গোধরা পরবর্তী ২০০২ এর ‘গুজরাট মডেল।’

৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে উত্তরপ্রদেশ লাগোয়া মুসলিম অধ্যুষিত বাবরপুর, মৌজপুর, করদামপুরী, চাঁদবাগ, গকুলপুরী,ভোজনপুরা, যমুনা বিহার, বিজয় পার্ক, জাফরাবাদের মতো এলাকায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে সংগঠিত কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা। উত্তর-পূর্ব দিল্লিতেই সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা ভোটে আসন পেয়েছে বিজেপি। বাবরপুরের সভা থেকেই অমিত শাহ শাহিনবাগে ‘কারেন্ট’ লাগাতে বলেছিলেন। দিল্লি বিধানসভা ভোটের সময়ে শাহিনবাগকে ঘিরে ব্যাপক ঘৃণা এবং উসকানি ছড়িয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সহ বিজেপি’র শীর্ষনেতারা।

দিল্লিতের হারের পরও সেই উসকানি চলেছে। সবশেষে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রের প্রত্যক্ষ উসকানির পর এই হামলা শুরু হয়। সে কথা এদিন কার্যত মেনে নিয়েছেন পূর্ব দিল্লির বিজেপি সাংসদ গৌতম গম্ভীরও। যারা উসকানি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তিনি। তিনদিন ধরে দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদীদের হিংসার ব্যাপকতায় স্পষ্ট হয়ে গেছে অনেকদিন ধরেই এই প্রস্তুতি ছিল।

মিশ্র জনবসতি এলাকার সংখ্যালঘুরা জানিয়েছেন, হামলাকারীরা বাইরের লোক। অভিযোগ উঠছে সংলগ্ন উত্তরপ্রদেশ থেকে লোক আনছে বিজেপি। ভয়ঙ্কর এই পরিস্থিতির মধ্যেও বিজেপি’র উসকানি অব্যাহত আছে। হিমাচল প্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী জয় রাম ঠাকুর বলেছেন, যারা ভারত মাতা কী জয় বলবে, তারাই শুধু এই দেশে থাকবে।

ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধীতা গত তিনদিন ধরে টানা বিক্ষোভ-সহিংসতা-সংঘাতে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে রাজধানী নয়াদিল্লি। এর মাঝেই সোমবার দুদিনের সফরে ভারতে আসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার এই সফরের আগে নাগরিকত্ব আইনবিরোধী বিক্ষোভ ব্যাপক আকার ধারণ করে।

এমন পরিস্থিতিতে দিল্লি বিজেপির এক নেতা বিক্ষোভকারীদের দমাতে দলীয় বলপ্রয়োগের হুমকি দেয়ার পর রাজধানীর বিভিন্ন অংশে নতুন করে বিক্ষোভ শুরু হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার সন্ধ্যায় যখন দিল্লিতে পৌঁছান তখনও বিক্ষোভ-সংঘর্ষ, জ্বালাও পোড়াও অব্যাহত থাকে।

নাগরিকত্ব আইনবিরোধীদের সঙ্গে বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষে গত তিনদিনে ২০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এছাড়া দিল্লির মসজিদ ও মুসলিমদের দোকানপাট, বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে।

ট্রাম্পের উপস্থিতিতেও দিল্লি বিক্ষোভ অব্যাহত থাকলেও এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ভারত ছাড়ার আগে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, নাগরিকত্ব আইন ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। দেশের মানুষের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সঠিক সিদ্ধান্তই নেবেন।

গত বছরের ১১ ডিসেম্বর ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হয়। পরদিন রাষ্ট্রপতি এই বিলে স্বাক্ষর করলে সেটি আইনে পরিণত হয়। বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ করছেন দেশটির হাজার হাজার মানুষ।

I'm at Mustafabad, near the Loni Border, and new fires (set post-9pm) are burning in front of our eyes - Muslim jhuggis and tempos, according to onlookers - by masked men shouting JSR. Delhi Police are present saying they are unable to intervene. pic.twitter.com/tXT6k2qcXB

— Raghu Karnad (@rkarnad) February 25, 2020

এসআইএস/এমকেএইচ