ত্রিশের অধিক দেশে ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস। নতুন করে আক্রান্ত দেশের সংখ্যা বাড়ছেই। ভাইরাসটির বিস্তার হচ্ছে খুব দ্রুত। অনেকভাবে ভাইরাসটি প্রতিরোধের চেষ্টা সত্ত্বেও চীনে উৎপত্তি হওয়া এই ভাইরাসকে ভৌগলিকভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি। তাই আশঙ্কা থেকে যায়—করোনাভাইরাস কি শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক মহামারিতে রূপ নেবে?
Advertisement
করোনাভাইরাস সংক্রমণে আসন্ন বৈশ্বিক মহামারির শঙ্কা শত বছর আগের ‘স্প্যানিশ ফ্লু’র কথা মনে করিয়ে দেয়। ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সাল—তিন বছরে ওই মহামারি ভাইরাস ১০ কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিলো। নামটি স্প্যানিশ ফ্লু হলেও স্প্যানিশরা কিন্তু এই ভাইরাসের জন্য দায়ী ছিলো না।
যুক্তরাষ্ট্র যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য সৈন্য প্রস্তুত করছিলো তখন দেশটির কানসাসের ক্যাম্প ফান্সটনের স্যানিটেশন অব্যস্থাপনা থেকে উৎপত্তি নেয়া এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে পুরো পৃথিবী আক্রান্ত হয়েছিলো। ওই ক্যাম্পের সেনারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে পাড়ি জমানোর সময় প্রাণঘাতী ভাইরাসটি সঙ্গে করে নিয়ে যায়। তার খেসারত হিসেবে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও স্পেনসহ পুরো ইউরোপে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে।
এশিয়া ও আফ্রিকাসহ প্রশান্ত মহাসাগরের বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতেও অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছিলো এই ভাইরাস। এর সংক্রমনের লক্ষণ ছিলো জ্বর ও শ্বাসকষ্ট। অক্সিজেনের অভাবে দেহ কিছুটা নীলবর্ণ ধারণ করতো এবং শ্বাসনালীতে সংক্রামণের কারণে নাক দিয়ে রক্ত পড়তো। কেউ হয়তো সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর অসুস্থতা বোধ করেছেন, এরপর নাস্তা সেরে অফিসে যাওয়ার পথেই মৃত্যুবরণ করতেন।
Advertisement
কানসাসের ক্যাম্প ফান্সটনের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত রোগীরা
স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মোট মৃতের সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন। ধারণা করা হয়, প্রকৃত সংখ্যা পৃথিবীর দুটি বিশ্বযুদ্ধের সম্মিলিত মৃতের সংখ্যা থেকেও ছিল বেশি। ভাইরাসটির সংক্রমণে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই মৃত্যুবরণ করে ছয় লক্ষাধিক মানুষ, যুক্তরাজ্যের প্রায় আড়াই লাখ মানুষ আর স্পেনে তার থেকেও বেশি।
এছাড়া ইউরোপের আরেক দেশ ডেনমার্কে ভাইরাসটির সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা ছিল ৫ লাখেরও বেশি, জাপানে মারা যায় ৪ লাখ। ব্রিটিশ ভারতে স্যানিটেশন অব্যবস্থাপনার কারণে এক দেশ হিসেবে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ মারা গিয়েছিল তখন। প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রাণ দিয়েছিলো এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের কারণে।
এবার কোভিড-১৯ প্রসঙ্গে আসা যাক। ইতালিতে এখন পর্যন্ত ৭ জনের মৃত্যু ইউরোপ ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোর উৎকণ্ঠাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এখানে ইইউভুক্ত দেশগুলোতে সীমানার বাধা না থাকায় মানুষ অনায়াশেই এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাতায়াত করে। ফলে এর বিস্তারে আশঙ্কায় উৎকণ্ঠিত হওয়াটাও যুক্তিসঙ্গত।
Advertisement
গতকাল সোমবার স্পেনের বার্সেলোনা শহরে ৭ থেকে ৮টি ফার্মেসিতে খোঁজ নিয়েও মাস্ক খুঁজে পাচ্ছি না। পরে আজ বুধবার সকালে ৪০ ইউরো খরচ করে ১৫টি মাস্ক কিনেছি নিজের পরিবারকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। কোন রোগের প্রাদূর্ভাব যখন একসঙ্গে অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়ে তখন তাকে বৈশ্বিক মহামারি বলে ঘোষণা করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) প্রধান টেড্রস গেব্রেইয়েসাস জোরালোভাবে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর সুযোগ দিন দিন কমে আসছে। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাংলিয়ার অধ্যাপক পল হান্টার বিবিসিকে বলেন, চীনের বাইরে অন্যান্য দেশেও যেভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে, তা খুবই উদ্বেগজনক।
ব্রিটিশ ওই অধ্যাপক আরও বলেছেন, যে নির্দিষ্ট সময়ের পর একটি বৈশ্বিক মহামারি আর ঠেকানো সম্ভব হবে না বলে মনে করা হচ্ছে, গত চব্বিশ ঘন্টায় সেই সময় আরও কাছাকাছি চলে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য প্রচেষ্টার কমতি না থাকার পরও অল্প সময়ের মধ্যে ত্রিশের অধিক দেশে ছড়িয়ে পড়াটা আশঙ্কাজনক।
করোনাভাইরাস মূলত একটি জু-নটিক ভাইরাস। মানুষের শরীরে সংক্রমণের আগে এটি কোন প্রাণীর শরীরে ডেভলপ করে। তারপর মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটিয়ে নিজেদের ডেভলপ করে। একজন মানুষের শরীরে ডেভলপ করার পর হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে একজন থেকে তা ব্যাপক মানুষকে সংক্রমিত করে এবং ছড়িয়ে পড়ে।
চীনের পর এই ভাইরাসের সংক্রমণ এখন পর্যন্ত বেশি ধরা পড়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি ও ইরানে। করোনাভাইরাসে চীনে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭৮ হাজার আক্রান্ত এবং ২ হাজার ৬৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। চীনের পর দক্ষিণ কোরিয়াতে আক্রান্ত ৯৭৭ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের। চীনের পর সবচেয়ে বেশি ১৬ জন মারা গেছে ইরানে।
এছাড়া ইতালিতে ২২৯ জন আক্রান্ত ছাড়াও মৃত্যুবরণ করেছে ৭ জন। জাপানে আক্রান্তের সংখ্যা এখন ১৫৯ এবং দেশটিতে কোভিড-১৯ রোগে মৃত্যুবরণ করেছেন একজন। ইরানে আক্রান্তের সংখ্যা ৯৫। এছাড়া চীনের আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হংকংয়ে ২ জন ছাড়াও অন্যান্য দেশে একজন করে মোট ৭ জনের মারা গেছেন।
প্রাণঘাতী এই রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসাও চলছে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায়। আক্রান্তদের থেকে দূরে সরে থাকার প্রচেষ্টায় ব্যহত হচ্ছে তাদের সেবা দেবার ব্যবস্থা। আক্রান্তদেরকে পরিবার থেকে আলাদা করা হচ্ছে। মৃতের সৎকার কাজগুলোও হচ্ছে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায়। আক্রান্ত এলাকাগুলোকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হচ্ছে।
ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল হিসেবে বিবেচিত চীনের উহান ও অন্যান্য শহর ছাড়াও ইতোমধ্যে ইতালির বেশ কয়েকটি শহরকে অবরূদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। সেখানে চলছে মাস্ক সঙ্কট। গতকাল খবরে দেখলাম, অবরূদ্ধ সময়ের কথা চিন্তা করে মানুষজন প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী কিনে সুপারমার্কেটগুলোর তাক খালি করে দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, করোনাভাইরাস যদি বৈশ্বিক মহামারি রূপ নেয়ও তারপরও এটিকে থামানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাইরাসটির সংক্রমণ ও বিস্তার উষ্ণ আবহাওয়া আসা পর্যন্ত যদি ঠেকিয়ে রাখা যায়; তাহলে উষ্ণতাপমাত্রায় ও বাতাসে ভাইরাসটি বেশিদিন টিকবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
যেমনটা অন্য কোন ফ্লু ভাইরাসের ক্ষেত্রেও হয়। তবে বিষয়টি নিয়ে তারা পুরোপুরি নিশ্চিত নন। আর যদি ভাইরাসটির প্রাদূর্ভাব থামিয়ে রাখতে দেশগুলো ব্যর্থ হয়, তাহলে সঙ্কট তৈরি হবে মানবিক এবং অর্থনৈতিক। আর সেটা কোন পর্যায়ে যেতে পারে সেটা শুধু ভবিষ্যতই বলে দিতে পারবে।
এসএ/জেআইএম