বিশেষ প্রতিবেদন

পিলখানা মামলা : রায়ের কপি তুলতেই লাগবে পৌনে ২ লাখ টাকা

দেশের ইতিহাসের বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মামলায় হাইকোর্টের দেয়া রায়ের পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করতে প্রায় তিন শতাধিক আসামি সার্টিফায়েড কপির জন্য আবেদন করেছেন। পেপারবুক দেখে কারও কারও খালাসের বিরুদ্ধে আবেদন করতে পারে রাষ্ট্রপক্ষও। আর আসামিপক্ষ বা রাষ্ট্রপক্ষ, যারাই আপিল করতে চাইবে, তাদের প্রত্যেকের সার্টিফায়েড কপি তুলতে দিতে হবে এক লাখ ৭৫ হাজার ৫৫৪ টাকা করে। সার্টিফায়েড কপির জন্য এত টাকা খরচের ব্যাপারে চিন্তিত আসামি ও রাষ্ট্র- উভয়পক্ষের আইনজীবীরা।

Advertisement

রাষ্ট্রের প্রধান আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল থেকে শুরু করে আসামিপক্ষের কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে এমন শঙ্কার কথা জানা গেছে। এমনকি আসামিদের পক্ষে হাইকোর্টে মামলা পরিচালনাকারী একজন সিনিয়র আইনজীবী আপিল বিভাগে লড়বেন কি-না, সেটা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করতে দেখা গেছে তাকে।

২০১৭ সালের নভেম্বরে হাইকোর্টের ঘোষিত রায়ে ১৩৯ জনের ফাঁসি, ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ২০০ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। খালাস দেয়া হয় ৪৫ জনকে। এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ লিপি প্রকাশ হয় ৮ জানুয়ারি। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের এক মাসের মধ্যে আপিল করার বিধান রয়েছে।

হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পর আপিল আবেদনের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আমি খবর নিয়েছি, এই মামলায় হাইকোর্টের রায়ের মোট পৃষ্ঠা হলো ২৯ হাজার ৫৯। এই রায়ের বিরুদ্ধে একজন আসামির আপিল আবেদন করতে এমনিতেই খরচ লাগবে। আর সার্টিফায়েড কপিই নিতে লাগবে এক লাখ ৭৫ হাজার ৫৫৪ টাকা। যদি কেউ ডাউনলোড করেও নেয়, সেটা সার্টিফায়েড করতে হবে জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প লাগিয়ে। সেখানেও একই অংকের খরচ লাগবে। এ পর্যন্ত সার্টিফায়েড কপির জন্য দরখাস্ত করেছেন ৩২৬ জন। এখন এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে, আমার মনে হয় একটা ডেডলক (অচলাবস্থা) সৃষ্টি হয়ে যাবে।

Advertisement

তিনি জানান, কারও কারও খালাসের আদেশের বিরুদ্ধে বিডিআরের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করবে। অন্যান্য আসামি যারা আছেন, ১৩৯ জন মৃত্যুদণ্ডিত বা ১৮৫ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডিত, এদের পক্ষে এই টাকা ব্যয় করা সম্ভব হবে কি-না, এটা নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এই ব্যাপারে আমি প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করব। আমি সময় করে তার সাথে কথা বলব, এটার সমাধান কীভাবে করা যায়!

খালাসপ্রাপ্তদের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, পেপারবুক দেখে আমাদের কাছে যদি মনে হয় খালাস দেয়াটা সঠিক হয়নি, সেক্ষেত্রে আপিল করব। যেগুলোর কম সাজা হয়েছে, সেগুলোর প্রত্যেকটি পড়ে দেখতে হবে। সবগুলোই যে করব একথা বলছি না। দেখে যেগুলো করা দরকার মনে হবে সেগুলো (আপিল) করব।

তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদরদফতরে পিলখানা ট্র্যাজেডির আপিল ও হাইকোর্টের রায়ের সার্টিফায়েড কপির খরচের বিষয়ে সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান জাগো নিউজকে বলেন, হাইকোর্টের রায় প্রকাশের পর সুপ্রিম কোর্টে আপিল আবেদন করার জন্য সার্টিফায়েড কপি তুলতে হয়। এই আপিল করতে কমপক্ষে ১৪টি আলাদা কপি (ভলিউম বা বই) তৈরি করতে হয়। আর সুপ্রিম কোর্টের আপিলে হাইকোর্টের রায়ের জাজমেন্ট মাস্ট লাগবেই। এফআইআর, চার্জশিট, সিজার লিস্ট, সাক্ষীর জবানবন্দি, বিচারিক আদালতের রায়ের কপি, এরপর হাইকোর্টের রায়ের কপি। এসব মিলিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয়।

Advertisement

আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় হাইকোর্ট থেকে ২৯ হাজার পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। আমি শুনেছি এই রায় হবে মোট ৩৬ হাজার পৃষ্ঠার। কারণ এখানে রায়ে দেয়া বিভিন্ন রেফারেন্স উল্লেখ থাকবে।

তিনি বলেন, আসামি বিডিআর সদস্যদের মধ্যে অনেকে খুবই গরিব। তারা এত টাকা দিয়ে সার্টিফায়েড কপি তুলে আপিল করতে পারবেন কি-না, আমার খুব শঙ্কা হয়। তাই যদি রাষ্ট্রপক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়, তারা যদি সার্টিফায়েড কপি তোলার ক্ষেত্রে গরিব আসামিদের সহযোগিতা করার বিবেচনা নেয়, তা হলে ভালো হবে।

এদিকে বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে লড়াই করা আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা রায়ের অনুলিপি চেয়ে আবেদন করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কপি পাইনি। এ কারণে আমরা রায়ের ফটোকপি দিয়ে আপিল করার জন্য অনুমতি চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে একটি আবেদন দিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানতে পারিনি। ফলে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারছি না।

এ মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া নিয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, এই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করার জন্য কতটা সময় প্রয়োজন হবে তা এই মুহূর্তে বলা যায় না।

বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ড থেকে খালাস চেয়ে হাইকোর্টে প্রায় ৩০০ আসামির পক্ষে লড়েছেন এই আইনজীবী। তিনি বলেন, ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণার পরপরই অনুলিপির জন্য হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় দরখাস্ত দিয়ে রেখেছিলাম। পূর্ণাঙ্গ রায়টি এতদিন প্রকাশ না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তারা তা দিতে পারেনি। গত ৮ জানুয়ারি রায় প্রকাশ হওয়ার পর আমরা জানলাম এটা ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার। তাই এই রায়ের সার্টিফায়েড কপি পেতে আসামিদের প্রত্যেককে দেড় লাখের বেশি টাকা গুনতে হবে।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের নামে পিলখানায় বিডিআর সদরদফতরে ঘটে এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড। ওই ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান। পরে বিচারের মুখোমুখি করা হয় ৮৪৬ বিডিআর জওয়ানকে। মামলার চার আসামি বিচার চলাকালে মারা যান।

২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর এ মামলায় ১৫২ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দেন বিচারিক আদালত। তাদের একজন ছাড়া সবাই তৎকালীন বিডিআরের সদস্য। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় ১৬১ জনকে। সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পান আরও ২৫৬ জন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৮ জন। সাজা হয় মোট ৫৬৮ জনের।

বিচারিক আদালতের ওই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন হলে ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় দেন আদালত। রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ২০০ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। খালাস দেয়া হয় ৪৫ জনকে।

রায় ঘোষণার দুই বছরের বেশি সময় পর গত ৮ জানুয়ারি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। হাইকোর্টের বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের স্বাক্ষরের পর সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার রায়টি প্রকাশ হয়।

এফএইচ/এইচএ/এমএআর/পিআর