সাহিত্য

সাহিত্যে প্রতিযোগিতা

একুশে বইমেলা বাঙালির অনেক বড় আবেগের জায়গা। প্রতি বছর এর নিয়মিত আয়োজন বাঙালি চিত্তকে বিমোহিত করে। দলবেঁধে মেলায় ছোটা নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নেওয়া, ধীরে ধীরে তালিকা করা, নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ্যের মধ্যে পছন্দের বইগুলো সংগ্রহ করা। আহা কী যে আনন্দের! যারা মেলায় আসতে পারে তারা নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করে, যারা পারে না তাদের আফসোসের শেষ নেই। ঢাকার বাইরে থাকা অনেকের স্বপ্নই থাকে জীবনে একবার হলেও বইমেলায় আসার।

Advertisement

একটি জাতি প্রতি বছরের একটি মাস দীর্ঘদিন ধরে কেবল বইমেলার জন্য নির্ধারিত রেখেছে এটা নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়। ফেব্রুয়ারি বইমেলার মাস। চাইলেই ফাগুনের আগুনে পুড়িয়ে ক্যালেন্ডারের ফেব্রুয়ারি মাসের নামও বদলে ফেলে বইমেলার মাস করা যায়।

বইমেলার আজকের উৎসবমুখরতার পেছনে আছে ত্যাগের মহিমা। বায়ান্নর শহীদদের রক্তপিচ্ছিল পথ পেরোনোর ইতিহাস। আছে মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহার মহতী উদ্যোগের সোনালি গল্প। মাত্র ৩২টি বইয়ের পসরা সাজিয়ে শুরু করা বই বিক্রির কার্যক্রম আজকের এই বৃহৎ পরিসর পেয়েছে। রাষ্ট্রই এখন যার আয়োজক, সরকারপ্রধান নিয়মিত উদ্বোধক।

এই মেলা বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রাণ সিঞ্জনকারী। হাজারো নতুন লেখক-প্রকাশক ও পাঠক সৃষ্টি করছে বইমেলা। বাংলাদেশে প্রকাশনা এখন একটি শিল্প, প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানও অনেক। বাতিঘর, পাঠক সমাবেশ বেঙ্গল গ্যালারিতে একটু ঢুঁ মারলেই বোঝা যায় প্রকাশনা শিল্পের জায়গাটা আজ কতটা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।

Advertisement

মানিক বন্দোপাধ্যায়-জীবনানন্দ দাশের মতো বড় মাপের লেখক-কবির জীবনের গল্প বর্তমানে লেখকদের লেখালেখিকে একমাত্র পেশা হিসেবে বেছে নেওয়াকে নিরুৎসাহিত করলেও লিখে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন অনেকেই। লেখালেখি একমাত্র জীবিকা না হলেও লিখে আয়ই হচ্ছে না এমনটা নয়। সবাই হুমায়ূন আহমেদ হতে না পারলেও যে অনেকটা এগিয়ে থাকছেন এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রকাশকেরও আজকাল রমরমা অবস্থা।

এসব হিসাব-নিকাশ অনেককেই ভাবাচ্ছে। সেই ভাবনা থেকে কেউ লেখক হচ্ছেন কেউবা হচ্ছেন প্রকাশক। কারও উদ্দেশ্যে সততা আছে কারও কারও শঠতাও লক্ষণীয়! অবাক হওয়ার কিছু নেই। সুযোগসন্ধানী চিরদিনই ছিল, আছে ও থাকবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এ যুগে কার কোন প্রতিভার স্ফূরণ কীভাবে ঘটে তা বলার অপেক্ষা রাখে না! ‘তুমি লেখিতে পারিলে আমিও পারিব না কেন?’ কিংবা ‘তুমি ছাপাইতে পারিলে আমি পারিব না কেন?’ নানামুখী চিন্তা থেকে শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা।

এ প্রতিযোগিতা বাংলা সাহিত্যকে একদিন বিশ্ব দরবারে অনেক উঁচুতে নিয়ে যাবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলা মহাকাব্যেও আমরা প্রতিযোগিতা দেখতে পাই। মাইকেল ‘মেঘনাদবধ’ লিখেছেন তারই ধারায় হেমচন্দ্রের ‘বৃত্র-সংহার’, নবীনচন্দ্রের ত্রয়ী (রৈবতক, করুক্ষেত্র ও প্রভাস)। এরপর এলেন মুসলমান কবিরাও। মহাশ্মাশান নিয়ে এলেন কায়কোবাদ, স্পেন বিজয় কাব্য শোনালেন ইসমাইল হোসেন সিরাজী।

সৃষ্টিশীল প্রতিযোগিতা সুন্দরের জন্ম দেয়। ‘তবে’ শব্দটি ব্যবহার করে ‘যদি’ যোগ করেই বলতে হয় তা যেন সুস্থ ধারায় থাকে। প্রতিবেশীর ঘরের রঙিন টেলিভিশন দেখে নিজের ঘরেও একটা আনার ইচ্ছার মতো অসংখ্য খায়েশ বাঙালি চিত্তে জাগবেই। সেই বাসনা পূরণের প্রক্রিয়াটা সৎ না থাকলেই বিপদ! তেমনি লেখক ও প্রকাশক হওয়ার প্রতিযোগিতাটাও যেন ‘সৎ’ থাকে ‘শঠ’ না হয়। যদিও এখন লেখকের কার্যক্রমই দৃশ্যমান হয় বেশি, প্রকাশক আড়ালেই রয়ে যান!

Advertisement

যাচ্ছেতাই লিখে লেখক হওয়া নিয়ে বিতৃষ্ণার অন্ত নেই! সেখানে যাচ্ছেতাই ছাপিয়ে প্রকাশক হওয়া ঠেকাবে কে? অবশ্যই রাষ্ট্র। মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমির দায় সবচেয়ে বেশি। বুঝতে হবে এটা জাতির জন্য প্রয়োজন। জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানও কাজে লাগানো যেতে পারে।

যদিও লেখকের স্বাধীনতা থাকবে, লেখালেখির স্বাধীনতা থাকবে, প্রকাশকেরও স্বাধীনতা থাকবে কিন্তু তা অবশ্যই একটা মানদণ্ড ঠিক রেখে। কে লেখক হবে কে হবে না এ প্রশ্ন করার অধিকার কারও নেই। আনা ফ্রাঙ্ক ডায়েরি লিখেই বিখ্যাত, রাওলিং বার বার প্রত্যাখ্যাত হয়েও দুনিয়াজোড়া নাম করেছেন।

জওহরলাল নেহেরু জেলে থাকা অবস্থায় তার ১০ বছর বয়সী মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে অনেক চিঠি লিখেছেন। ইংরেজিতে লেখা সেই চিঠিগুলোই আজ বিশ্ব ইতিহাসের স্মারক। তার বইটি বাংলায় অনূদিত হয়েছে ‘বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গ’ নামে। ভারতের এমন বড় মাপের নেতার কথা জেনে আমরা অবাক হই। সেই সঙ্গে আমরা বিস্মিত হই যখন জানতে পারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও লেখক। তার লেখা তিনটি বই আমরা পেয়েছি অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও সদ্য প্রকাশিত আমার দেখা নয়াচীন। এই লেখাগুলোও বাংলার ইতিহাসের অনন্য দলিল। দলমত নির্বিশেষে বইগুলো গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। অথচ স্বাধীনতার কয়েক দশক পেরিয়ে গেলেও আমরা জানতেই পারিনি লেখক বঙ্গবন্ধুর কথা।

তাই প্রতিভাকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কারও নেই। বইমেলার কারণে বাংলাদেশেও প্রতিভার স্ফূরণ ঘটছে। অনেকেই লিখছেন, ভালো বিষয় নিয়ে লিখছেন, ভালো লিখছেন ও জনপ্রিয়তাও পাচ্ছেন।

সেলফ পাবলিশিং বিশ্বজুড়ে সমাদৃত পদ্ধতি। অনেকেই লেখেন কিন্তু প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও সাড়া পান না। মনে করেন বইটি প্রকাশযোগ্য বা প্রকাশ করা দরকার তাই নিজেই ছাপানোর উদ্যোগ নেন। অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকেরও এমনটি করার দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু সেই কাজটাও বিধিবদ্ধ পদ্ধতিতে করতে হবে। বই ছাপানোর আগে কতগুলো ধাপ আছে সেগুলো অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। সেটি সুসম্পাদনার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। লেখালেখির দায়টা নিজেকেই বুঝতে হবে। নিজের কাজটা নিজেকেই ভালো করতে হবে।

অন্যদিকে প্রকাশনীগুলোকেও প্রকাশনার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। সম্পাদনার কাজটা ঠিকমতো হচ্ছে তো? লেখকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তো? লেখক রয়্যালটি পাচ্ছেন তো? এতগুলো প্রশ্ন করতেই হয়। কারণ, কিছু প্রকাশনীর টার্গেট হচ্ছে বইমেলা আর নতুন লেখক। দুঃখজনক হলেও সত্য কেউ কেউ মানুষের লেখক হওয়ার স্বপ্নকে পুঁজি করে ব্যবসা করছে! যদি কেউ কিছু প্রকাশ করতে চায় তাহলে তাদের কাছে গেলেই তারা একটা নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে তা প্রকাশ করে দেবে! এরপর সব দায় বেচারা লেখকের। লেখকের মাথা প্রকাশকের কাঁঠাল! প্রচারণার যতগুলো মাধ্যম আছে সবগুলোতে নিজের ঢোল নিজে পেটাবেন লেখক। প্রয়োজনে মেলায় ফেরি কিংবা নিজস্ব বিক্রয়কর্মীও নিয়োগ করবেন। প্রকাশকের আর কোনো দায়ও নেই! তিনি কেবল এই মেলা শেষ করে আগামী মেলার অপেক্ষায় থাকবেন। যিনি একবার লেখক হলেন তিনি তার নিয়মিত ‘গ্রাহক’! পরবর্তীতেও অনেককেই পাওয়া যাবে যিনি কিছু ছাপাতে চান! লেখকের থেকে নেওয়া টাকা, বই বিক্রির টাকা সবই প্রকাশকের। বই অবিক্রীতও থাকতে পারে। তা যদি একসময় কেজি দরেও বিক্রি হয় সে টাকাও প্রকাশকের। আবার ‘আপনার বই বিক্রি হয় না’ প্রকাশক যখন লেখকের দিকে তাকিয়ে এমন প্রশ্ন ছুড়েন তখন বেচারা বিপদে পড়বেই! তিনি তখন তার পরিসরে পরিচিত মহলের হাতে হাতে বই পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন। এসব নানামুখী চিন্তা তাকে বিপথেও নিতে পারে। জনপ্রিয় হওয়ার জন্য কেউ লিখে না। তবে লিখে কেউ কেউ জনপ্রিয় হতে পারেন। উদ্দেশ্য সৎ থাকলেই সব ঠিক থাকবে এমনটা নাও হতে পারে। লেখকের মৃত্যুর পরও তার লেখা নন্দিত হয়, এমন উদাহরণও আছে।

সেলফ পাবলিশিংয়ের ‘চলমান রীতি’কে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। লেখক খরচ করুক, প্রকাশকও সহযোগিতা করুক। বিধিবদ্ধ উপায়ে বাংলা সাহিত্যেও ভালো কিছু সৃষ্টি হোক। সবকিছুই সেরা হবে এমনটা নয়, তবে অনেক কাজের ভিড়ে কিছু কাজ ভালো হবে এমন সম্ভাবনা থাকে, যা আশার সঞ্চার করে হতাশ করে না।

বাংলা একাডেমির বইমেলায়ও কিছু অসঙ্গতি আছে। সেগুলো দূর করার পদক্ষেপ নিতে হবে। আবার তা যেন অতিনিয়ন্ত্রণ না হয়। সাহিত্যে যে প্রতিযোগিতা চলছে তা অতীত ইতিহাসের ধারাতেই চলছে। সে প্রতিযোগিতা চলুক সুস্থ ধারায়। বাংলা সাহিত্য বিশ্ব দরবারে আরও মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এই প্রত্যাশা।

এসএইচএস/এমএস