বিশেষ প্রতিবেদন

খেটে খাওয়া মানুষই অর্থনীতির কাঠামো শক্ত রেখেছে

অধ্যাপক এম এম আকাশ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। চেয়ারম্যান, ব্যুরো অব ইকোনমিকস রিসার্চ। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য।

Advertisement

বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দীর্ঘ আলোচনায় দেশের উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে নির্মোহ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। গণতন্ত্রহীন রাজনীতিতে কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন এই বিশ্লেষক। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : অর্থনীতি ও উন্নয়ন নিয়ে নানামুখী আলোচনা আছে। মুজিববর্ষের আয়োজন চলছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও আসছে। বাংলাদেশের কোথায় যাওয়ার কথা ছিল, আর কোথায় যেতে পারল?

এম এম আকাশ : সংবিধানের চারটি মূলনীতি অনুসারে আমাদের অর্থনীতি হওয়ার কথা ছিল সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা যারা প্রণয়ন করছিলেন, তাদের শেখ মুজিব নির্দেশ দিয়েছিলেন সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে যেন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

Advertisement

সেই লক্ষ্যেই কলকারখানাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রীয় খাতে আনা হয়। আমরা যদি প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সঙ্গে তুলনা করে মূল্যায়ন করি, তাহলে দেখব বাংলাদেশ আজ সেখান থেকে যোজন যোজন দূরে নয়, একেবারে উল্টো পথে হাঁটছে।

জাগো নিউজ : এর তো একটি প্রেক্ষাপটও আছে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড…

এম এম আকাশ : হ্যাঁ। ১৯৭৫ সালের পর পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়। মূলত লুণ্ঠনমূলক পুঁজিবাদ। এখনও সেই লুণ্ঠনমূলক পুঁজিবাদের ধারা অব্যাহত আছে।

জাগো নিউজ : কিন্তু মানুষের তো পরিবর্তন ঘটল। রাষ্ট্র, সমাজের যে উন্নয়নের কাঠামো দাঁড়িয়েছে, তা তো অস্বীকার করা যায় না?

Advertisement

এম এম আকাশ : লুণ্ঠনমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেও কয়েকটি খাত আছে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আশীর্বাদ। মূলত এগুলো উৎপাদনমূলক খাত, যেখানে মানুষ তার ভাগ্য বদলে সম্পৃক্ত হয়েছে।

যেমন- বাংলাদেশের কৃষক। সবুজ বিপ্লবের যে প্রযুক্তি, তা কৃষকরা ভালো করে ব্যবহার করছেন। সার, উন্নত বীজ, পানি ব্যবহার করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিরা অল্প জমিতে সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করছেন। একই জমি বছরে তিনবারও ব্যবহার করছেন। ফলে আবাদি জমি কমলেও, জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হলেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, যেখান থেকে রফতানির কথাও বিবেচনা করা হচ্ছে।

খাদ্যশস্যের বাইরেও নানা রকম উৎপাদনে সফলতা এসেছে। যেমন- মাছ, মাংস, দুধ, ডিমে ব্যাপক উৎপাদন বেড়েছে। অকৃষি খাতেও উৎপাদন বেড়েছে। এতে মানুষের হাতে টাকা আসছে। সেই টাকা দিয়ে কৃষক তার সন্তানদের শহরে পড়াতে পারছেন। কৃষক এখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পণ্যগুলোও কিনতে পারছেন।

এরপর পোশাকশিল্প। এটি একেবারেই উৎপাদশীল একটি খাত, যেখানে অসংখ্য উদ্যোক্তা এসেছেন। অনেকেই ব্যাংকের ঋণ নিয়ে এখানে বিনিয়োগ করছেন। যারা খেলাপি হচ্ছেন না, আবার টাকা বাইরে পাচারও করছেন না। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন। যদিও সেখানে কমপ্লায়েন্স নিয়ে প্রশ্ন আছে। শ্রম আইনও ঠিক মতো পালিত হচ্ছে না।

সবশেষে বলব, প্রবাসী শ্রমিকের কথা। প্রায় এক কোটি প্রবাসী বাইরে শ্রম দিচ্ছেন। তারা যে আয় করছেন, তার শতকরা ৮০ শতাংশই দেশে পাঠাচ্ছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামো শক্ত রেখেছেন মূলত সাধারণ খেটে খাওয়া এই চার ধরনের মানুষ।

জাগো নিউজ : এর বিপরীত ধারা নিয়ে কী বলা যায়?

এম এম আকাশ : দেশের পুঁজিপতিরা বিনিয়োগ না করে টাকা বাইরে পাঠাচ্ছেন। হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। দুর্নীতি, ঘুষ, গণতন্ত্রহীনতা- এগুলো সবই হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক সূচক। নেতিবাচক এই অর্থনীতির ধারা নিয়েই আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পদার্পণ করতে যাচ্ছি।

জাগো নিউজ : এগিয়ে রাখবেন কোন ধারাকে?

এম এম আকাশ : গ্লাসের অর্ধেক পানি নিয়ে যেমন দু’ধরনের আলোচনা হয়, এখানেও ঠিক তা-ই হতে পারে। একটি পক্ষ বলবে কৃষকের অর্জন, প্রবাসী শ্রমিকদের আয়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, সামাজিক নিরাপত্তা, প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতি, স্বাস্থ্যসেবা যদি আরেকটু বাড়ানো যেত, তাহলে বাংলাদেশ আগেই মধ্যম আয়ের দেশ বা উন্নত দেশ হতো। ইতিবাচকভাবে যারা দেখছেন, তারা এগুলোকেই বাংলাদেশের মডেল দেখছেন।

আবার উল্টো দিকের কথা আরও ব্যাপক। এর মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি সবাইকে স্বীকার করতে হবে। যারা উন্নয়নের কথা বলেন, তারাও এই বৈষম্যের কথা স্বীকার করেন। যদিও তারা দারিদ্র্যের হার কমেছে বলে দাবি করেন।

দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য রেখার ওপরে অনেকেই উঠেছেন বটে। তবে সেটা শম্বুক (শামুক) গতিতে। অপরদিকে ধনীরা আরও ধনী হয়েছেন অশ্বের গতিতে। বৈষম্যটা ঠিক এখানেই। মধ্যবিত্ত শ্রেণির আপেক্ষিক গুরুত্ব বাড়ছে ঠিক। কিন্তু এরপরই বিশাল ফারাক, যেখানে অনেক উঁচুতে অল্পকিছু লোকের হাতে অধিক সম্পদ। এই উচ্চবিত্তদের জাতীয় শিকড় বাংলাদেশে নেই। বিদেশে বাড়ি তাদের। তাদের সন্তানরা বাইরে পড়েন। বাইরে ব্যবসা করেন। তারা দেশে আয় করে বিদেশে পাচার করছেন। ট্যাক্স দিচ্ছেন না। এটিই আমাদের অর্থনীতির উল্টোপথ, যেখানে বৈষম্যটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এই উচ্চবিত্তরা মূলত নিয়মের ধার ধারেন না। ঘুষ, দুর্নীতি, ম্যানেজ করে প্রশাসনকে বশে আনছেন। এতে গোটা অর্থব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা কলুষিত হচ্ছে।

জাগো নিউজ : তাহলে কী ইতিবাচক ও নেতিবাচক ধারা একই সঙ্গে চলবে?

এম এম আকাশ : না। এই দুটি ধারা দীর্ঘদিন একসঙ্গে চলবে না। একটি কৃষ্ণপক্ষ, অন্যটি শুক্লপক্ষ। হয় কৃষ্ণপক্ষ (অমাবস্যা) শুক্লপক্ষকে (পূর্ণিমা) গ্রাস করবে নতুবা শুক্লপক্ষ কৃষ্ণপক্ষকে গ্রাস করবে।

সবকিছু নির্ভর করবে রাজনীতির ওপর। রাজনীতি যদি লুটেরা ব্যবসায়ীদের হাতে পরিপূর্ণভাবে চলে যায়, তাহলে কৃষ্ণপক্ষ শুক্লপক্ষকে গ্রাস করে ফেলবে।

জাগো নিউজ : রাজনীতি তো এখন ব্যবসায়ীদের হাতেই…

এম এম আকাশ : হ্যাঁ, গত নির্বাচনে রাজনীতির প্রায় পুরোভাগই ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরেই তো বাংলাদেশে ক্ষমতার রাজনীতি।

তারেক রহমানের আধিপত্য ও ভুল রাজনীতির কারণে বিএনপি অপরাপর দুর্বল দল। বিএনপিকে আর সেই অর্থে ধর্তব্যের মধ্যে রাখছেন না মানুষ। বিএনপি আর বিকল্প হতে পারছে না। জাতীয় পার্টি আগেই শেষ হয়ে গেছে।

এখন একক আধিপত্য আওয়ামী লীগের। কিন্তু বর্তমানে আওয়ামী লীগের শ্রেণিগত চরিত্র বদলে গেছে। আওয়ামী লীগের জন্ম মাটি-মানুষের মধ্যে। দলটির নেতা শেখ মুজিবুর রহমান শুধু স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেননি, তিনি শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আরও পদক্ষেপ যখন নিয়েছিলেন, তখন তাকে মেরে ফেলা হলো। আওয়ামী লীগের অতীত খুবই উজ্জ্বল।

কিন্তু শেখ মুজিবের হত্যার পর আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এলো, তখন আত্মসমর্পণ করেই ক্ষমতায় এলো। শেখ মুজিব হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের মধ্যে থাকা দক্ষিণপন্থীদের এবং প্রাক্তন চীনপন্থীদের নিয়ে সরকার পরিচালনা করতে থাকলেন। এরপরও জিয়াউর রহমান আদমজী জুট মিলকে জাতীয়করণই রেখেছিলেন, যদিও বিশ্বব্যাংকের চাপ ছিল বেসরকারি খাতে দেয়ার।

জিয়াউর রহমানের একটি নীতির প্রসঙ্গ বললাম। এরপর তাকেও হত্যা করা হলো। জিয়াউর রহমানের পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এসে সব শেষ করে দিলেন। এরশাদ সমাজতন্ত্রের পথ একেবারে বন্ধ করে দিয়ে বিদেশি সাহায্যের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যাংকের নির্দেশানুযায়ী অর্থনীতি নির্মাণ করতে শুরু করলেন। সেই এরশাদের সঙ্গে সমাঝোতা করেই আওয়ামী লীগ বারবার ক্ষমতায় এসেছে।

এএসএস/এমএআর/এমএস