নানা যুক্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিক সান্ধ্যকোর্স বন্ধ না করতে উঠেপড়ে লেগেছেন দেশের সর্বোচ্চ এ বিদ্যাপীঠের শিক্ষকরা। আজ সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) অনুষ্ঠেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় যেন সান্ধ্যকোর্স বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়া হয় সেজন্য দফায় দফায় ঘরোয়া বৈঠক করেছেন তারা। এমনকি সান্ধ্যকোর্স চালিয়ে যাওয়ার যুক্তি দেখিয়ে তারা উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছেন।
Advertisement
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সভাকে ঘিরে সান্ধ্যকোর্সের সাথে জড়িত ‘বেশি লাভবান’ বনাম ‘কম লাভবান’ শিক্ষকরা দফায় দফায় যে বৈঠক করেছেন, সেখানে দরকষাকষির মাধ্যমে তারা সান্ধ্যকোর্স চালিয়ে যাওয়ার মতই ব্যক্ত করেছেন। মতৈক্যের ভিত্তিতে তারা সান্ধ্যকোর্স চালু রাখার যৌক্তিকতা ও গুরুত্ব তুলে ধরবেন একাডেমিক কাউন্সিলের সভায়। পাশাপাশি বাণিজ্যিক সান্ধ্যকোর্স বন্ধ না করে এটিকে একটি বিশেষ নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সামনে প্রস্তাব তুলে ধরবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে সান্ধ্যকোর্স চালু রয়েছে, সেখানকার শিক্ষক প্রতিনিধিরা রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ২টায় ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের হাবিবুল্লাহ কনফারেন্স রুমে একটি ঘরোয়া সভা মিলিত হন। সভায় সান্ধ্যকোর্স নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা ও পর্যালোচনা করেন তারা। এতে দুই পক্ষের শিক্ষকরা সান্ধ্যকোর্স বন্ধ না করার পক্ষেই মত দেন। একইসঙ্গে এটিকে নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসার আহ্বান জানান।
সভা শেষে শিক্ষকরা উপাচার্যের কাছে একটি স্মারকলিপি দেন। এসময় তারা সান্ধ্যকোর্স বন্ধ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কী কী প্রভাব পড়বে তা-ও অবহিত করেন উপাচার্যকে। তারা সান্ধ্যকোর্স নিয়ে ‘হঠকারী’ কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে এটি আরও পর্যালোচনার অনুরোধ জানান উপাচার্যকে।
Advertisement
শিক্ষকদের সভা শেষে ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জাগো নিউজকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সান্ধ্যকোর্স রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে যে পরিমাণ দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন তার অর্ধেকও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৈরি করা যাচ্ছে না। সারাবছরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র এক হাজার শিক্ষার্থী কাজে যোগদান করছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বাংলাদেশে এই সেক্টরে দক্ষ জনবল না থাকার কারণে ভারতীয়রা আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর ৪৮ হাজার কোটি টাকা বৈধপথে নিয়ে যাচ্ছে। যা বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি সান্ধ্যকোর্স বন্ধ করে দেয়, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তেমন কোনো লাভ হবে না। বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরও পিছিয়ে পড়বে। র্যাংকিংয়ে যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় তা হচ্ছে গবেষণা। গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় যা বরাদ্দ দেয় তা দিয়ে কিছুই হয় না। সান্ধ্যকোর্সের অর্থ দিয়েই শিক্ষকরা তাদের গবেষণার কাজ করে থাকেন। সান্ধ্যকোর্সে শিক্ষকদের তেমন লাভও নেই। একটা কোর্সে ক্লাস করালে চার মাসে এক বা সোয়া লাখ টাকা দেয়৷ যা হিসাব করলে মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা থাকে। অংকটা খুব বেশি নয়। এখন যদি প্রশাসন সান্ধ্যকোর্স বন্ধ করে দেয় তাহলে শিক্ষকরা অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেবেন। এই শিক্ষকদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে পরিমাণ বেতন দিচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিলে তার চার-পাঁচগুণ বেশি বেতন দেবে। এতে দেখা যাবে, বিশ্ববিদ্যালয় আরও ক্ষতির মুখে পড়বে।
সভা শেষে আরও কয়েকজন শিক্ষক বলেন, এফবিএসে (বাণিজ্য অনুষদ) যে লাল-নীল বাতি জ্বলে তা সান্ধ্যকোর্স থেকে আয় হওয়া অর্থে করা। এমবিএ’র এত বড় বিল্ডিং, ক্লাসে এসি, ভালো ভালো চেয়ার- এগুলো কাদের টাকায় হয়েছে? বিশ্ববিদ্যালয় কয় টাকা দিয়েছে? এগুলো সব সান্ধ্যকোর্সের আয়ে হয়েছে।
জানা যায়, ওই সভায় বেশিরভাগ শিক্ষকই সান্ধ্যকোর্স বন্ধ করার বিপক্ষে মত দেন। তারা মনে করেন, সান্ধ্যকোর্সের টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বড় বড় কাজ হয়েছে। এছাড়া সান্ধ্যকোর্সে অংশ নেয়া বিভাগ ও ইনস্টিটিউটগুলো যারা অংশ নেয়নি তাদের চেয়ে বেশি উন্নত ও গতিশীল। আর সান্ধ্যকোর্সে নেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম ও বিল্ডিংয়ের যথাযথ ও লাভজনক ব্যবহার হয়। এসময় কয়েকজন শিক্ষক কলাভবনের উদাহরণ টেনে বলেন, এই যে দেখেন কলাভবন দুপুর ২টার পর বন্ধ হয়ে যায়। এখানে কেউ থাকে না।
Advertisement
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সবচেয়ে লাভজনক সান্ধ্যকোর্স নেয়া এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করা শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, বাণিজ্য অনুষদের বেপরোয়া বাণিজ্যের কারণে অন্যান্য বিভাগের সান্ধ্যকোর্স বন্ধের কথা উঠেছে৷ সান্ধ্যকোর্স বন্ধ হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ক্ষতি হবে। তাছাড়া এই শিক্ষার্থীরা তখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। সান্ধ্যকোর্স বন্ধ করলে প্রাইভেট-পাবলিক সব জায়গা থেকে বন্ধ করতে হবে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি বন্ধ করে দেয় তাহলে এটার দুর্ভোগ বাংলাদেশের ওপর পড়বে। কারণ, রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে জড়িত অনেক ব্যক্তিও সান্ধ্যকোর্সের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা উপাচার্য স্যারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। উপাচার্য স্যার বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। আশা করি আজকের মিটিংয়ে সান্ধ্যকোর্স বন্ধ করার কোনো সিদ্ধান্ত হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি-নির্ধারকেরাও সান্ধ্যকোর্স বন্ধের বিরোধিতা করেছেন। তারা সান্ধ্যকোর্স নিয়ে একটি নীতিমালা তৈরির সিদ্ধান্ত দেবেন।
গত ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বক্তৃতাকালে রাষ্ট্রপতি ও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য মো. আবদুল হামিদ সান্ধ্যকোর্সের বিষয়ে তার বিরক্তি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ইভিনিং শিফট আমার ভালো লাগে না। এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় দিনে সরকারি আর রাতে বেসরকারি চরিত্র ধারণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সন্ধ্যায় মেলায় পরিণত হয়। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমি শুনেছি, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসে ২২টি কোর্স আছে, প্রতি কোর্স সাড়ে ১০ হাজার করে ২ লাখ টাকার বেশি হয়। এর অর্ধেক পায় বিভাগ, বাকি অর্ধেক পান শিক্ষকরা। বিভাগের টাকা কী হয় জানি না কিন্তু শিক্ষকরা পান।
এসব কোর্সের কারণে শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন রাষ্ট্রপতি।
তার ওই বক্তব্যের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সান্ধ্যকোর্সের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুরু করে। কিন্তু এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক প্রতিষ্ঠানেই আবার এ ধরনের কোর্স চালিয়ে যাওয়ার তৎপরতা দেখা যাচ্ছে।
এইচএ/পিআর