এলিজাবেথ ড্রিউ
Advertisement
নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সমসাময়িক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদি ক্রমবর্ধমান স্বেচ্ছাচারী, প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং বিপজ্জনক ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও চার বছরের জন্য ক্ষমতায় আসেন তাহলে তার প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে যুক্তরাষ্ট্রের বহু সময় লাগবে।
দুই দলের মধ্যে সাধারণত বড় ধরনের যে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা হয় তা চলতি বছরের নির্বাচনে হচ্ছে না। ডেমোক্র্যাটদের প্রথমে তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করতে হবে; তাহলেই প্রতিযোগিতা হালে পানি পাবে।
দেশের সর্বোচ্চ পদ জয়ের জন্য সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তৃতীয় প্রচেষ্টা প্রথম দুবারের চেয়ে কিছুটা ভালো হবে। বাইডেন পছন্দসই প্রার্থী। তিনি একজন উপযুক্ত মানুষ, যার মাঝে সহানুভূতিও আছে। তার ব্যক্তিত্ব সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও তার মাঝে অপ্রীতিকর কিছু নেই। জনপ্রিয়তা হয়তো তাকে নির্বাচনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারে; তবে তার মাঝে প্রেসিডেন্টসুলভ আচরণের ঘাটতি আছে। একটি নির্দিষ্ট মর্যাদা এবং দূরত্ব তার অর্বাচীনতাকে তুলে ধরে। বাইডেন যেহেতু বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তাই ডেমোক্র্যাটরা সহজেই অনুমান করে নেবেন তার পরিচালন যোগ্যতা কতটুকু!
Advertisement
এলিজাবেথ ওয়ারেনের ক্যাম্পেইনের খবরও চাউর হয়েছে। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তিনিও সাড়া দিয়েছেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমারও পরিকল্পনা আছে’ বলেও জানিয়েছেন। স্থানীয় সরকারে তার অভিজ্ঞতা আছে এবং তার উল্লেখযোগ্য অনুসারীও আছে। কিন্তু তাকে তেমন একটা শক্ত দেখা যাচ্ছে না। ফলে অনেকগুলো নতুন প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া অসম্ভব। সিনেটের তার অনেক সহকর্মী এমনকি জোটসঙ্গীও আমাকে জানিয়েছেন যে, তিনি ভালো কিছু পারবেন না। তার নাক সিটকানো আচরণ তারা অপছন্দ করেন। তাদের মন্তব্য কেবল ভক্তদের সঙ্গে সেলফি দিয়ে সব উতরে যাওয়া অসম্ভব।
সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সও অতিরিক্ত প্রতিশ্রুতির শিকার। তরুণ ভোটারদের মধ্যে এখনও তিনি সবচেয়ে ভালো করেন। যদিও প্রবীণরা প্রশ্ন তোলেন, ‘কীভাবে তিনি তার দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করবেন?’ যেমন- সরকারি কলেজগুলো অবৈতনিক করা ও ছাত্রদের ঋণ মওকুফ করা।
ওয়ারেন এবং স্যান্ডার্সকে ‘সবার জন্য স্বাস্থসেবা’ তথা সর্বজনীন স্বাস্থ্য বীমার জন্যই অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হবে। কেউই দেখায়নি কীভাবে মাত্র একবার অর্থ প্রদান পদ্ধতিতে ওবামা কেয়ারকে প্রতিস্থাপন করা যাবে, যা মধ্যবিত্তদের ওপর অতিরিক্ত করারোপ করবে না। কিছু সংস্থা এর বিরোধিতা করছে। কারণ এটা তুলনামূলক ভালো স্বাস্থ্যসেবার পরিকল্পনাকেই প্রতিস্থাপন করবে। যে জন্য তারা আপস করেছিল। ফলে অন্যান্য সুবিধাও পরিত্যাগ করতে হবে (যদিও পরে ওয়ারেন তার প্রস্তাব সমন্বয় করেছিলেন কিন্তু তা বিশ্বাসযোগ্য নয়)।
স্যান্ডার্স একজন স্বঘোষিত ‘গণতান্ত্রিক-সমাজতন্ত্রী’ যা একটি বিরক্তিকর কাঠামো। তা এমন সময়ে যে সময়ে ট্রাম্পকে হারানোর জন্য দলের মধ্যে ঐক্য খুবই প্রয়োজন। আদর্শিক কট্টরতা স্যান্ডার্সের অনুসরণকে সীমিত করে। এ কারণে তিনি তার নির্বাচনক্ষেত্রটাকে বড় করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারপরও তিনি নিউ হ্যাম্পশায়ারে বিজয়ী হয়েছেন, যা তার নিজের অঞ্চলের সীমানার ভেতর। যদিও তিনি ২০১৬ সালের চেয়ে ৫০ শতাংশ কম ভোট পেয়ে জিতেছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তার মনোনয়ন পাওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।
Advertisement
রাজনীতি সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকরা তাকে সহযোগিতা করছেন। কারণ বিতর্ক হলেই তারা একটি নতুন গল্প পাবেন। নিউ হ্যাম্পশায়ারের নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে সিনেটর এমি ক্লোবুচার সেখানে ঢেউ তুলেছিলেন। যদিও সেখানে তিনি তৃতীয় হন (আইওয়াতে হয়েছিলেন পঞ্চম)। কিন্তু বিতর্ক প্রেসিডেন্সির জন্য দুর্বল নির্দেশক। এক্ষেত্রে তারা যাচাই করে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা, বুদ্ধিমত্তা এবং দূরদর্শিতা। কিন্তু তারা প্রার্থীর মেজাজ, বিচারবুদ্ধি, আগ্রহ, প্রজ্ঞা এবং কূটনৈতিক দক্ষতার সামান্যই প্রকাশ করে।
এখন সিনেটর ক্লোবুচারের আচমকা সরব হওয়া তার খ্যাতি ম্লান করে দিয়েছে। কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগের কারণে তার জন্য উপরের স্তরের মনোযোগ আকর্ষণ এবং সাহায্য ধরে রাখা কষ্টকর হবে। কিন্তু ক্লোবুচারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যও নেই। মিনেসোটার নির্বাচনে তিনি জয়ে দৃশ্যমান চিত্তাকর্ষক রেকর্ড গড়েছেন। যদিও সেখানে তার কোনো শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না যে, আচরণগত দিকের ওপর বিশেষ জোর দিতে হয়েছে (যদিও তার দাদা ছিলেন কোল মাইনার), যা তিনি তার কর্পোরেট সেক্টরের ব্যাকআপ বলে উল্লেখ করেননি। কৃষিশিল্পের দানব কার্গিলও এর মধ্যে পড়ে, যা আমেরিকার সবচেয়ে বড় ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানি এবং সবচেয়ে বিতর্কিতও বটে।
৩৮ বছর বয়সী পিট বাটিগিয়েগ প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন, তাকে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা এবং অস্বাভাবিক আত্মসংযমের জন্য ধন্যবাদ। প্রতিপক্ষ তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে একটি ছোট্ট শহরের (সাউথ বেন্ড, ইন্ডিয়ানা) অভিজ্ঞতা বলে ঠাট্টা করেন। তিনি আফগানিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন সেনাদের মাঝে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করেছেন। বৈদেশিক নীতিতেও প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়েও অনেক বেশি চিন্তা চেতনার সংযোজন করেছেন, তবে তা বাইডেনের মতো নয়। একজন বিবাহিত সমকামী হিসেবেই তিনি সব কাজ দৃঢ়তার সঙ্গে করেছেন। তার রসবোধ আছে এবং চতুরভাবে বিপক্ষকে খোঁচা দিতে পারেন, যেমনটি ওবামা করতেন।
কিন্তু জয়ের জন্য এই কি যথেষ্ট? বিল ক্লিনটনও সহানুভূতি প্রদর্শন করেছিলেন। আমেরিকানরা ২০১২ সালে স্যান্ডি হুকের প্রাথমিক স্কুলে গণহত্যার সময় ওবামার কান্নাও দেখেছিল। দিও বাটিগিয়েগ কাঁদছে এমন দৃশ্য কল্পনা করাও কষ্টকর! একসময় ম্যাকিনজির পরিকল্পনাকারী থাকার কারণে তিনি জিতেছেন। মেয়র হিসেবে তিনি অনেক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ফলে সংখ্যালঘু ভোটারদের কাছে টানা তার জন্য কঠিন হবে। বুদ্ধিতে তীক্ষ্ণ এবং রসবোধে তিনি ট্রাম্পের চেয়েও ভয়শূন্য, যে কেউ এটা সহজেই অনুমান করতে পারে। তবে নির্বাচকমণ্ডলী সার্বিকভাবে একজন সমকামীকে গ্রহণ করবে কি না তা অজানা!
একসময় নিউইয়র্ক সিটির তিনবারের মেয়র মাইক ব্লুমবার্গ মতামত জরিপেও প্রস্ফূটিত হলেন, তিনি সুবিবেচনায় এলেন, যা তাকে স্রোতের মুখোমুখি করলো। উদাহরণস্বরূপ তিনি বর্ণবাদী হিসেবে অভিযুক্ত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক পথেঘাটে যে কোনো সন্দেহভাজনকে থামিয়ে তল্লাশির যে নিয়ম তিনি নিউইয়র্কে চালু করেছিলেন তা কঠিন সমালোচনার মুখে পড়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নারীবিদ্বেষের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। মেয়র হওয়ার আগে তিনি যেসব অশ্লীল বক্তব্য দিয়েছিলেন এখন সেগুলোও ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু ব্লুমবার্গ নিজের অঢেল সম্পদ ব্যয় করেছেন প্রচারণার জন্য এবং গুরুত্বপূর্ণ জোট গঠন করেছেন। এজন্য তিনি প্রার্থীদেরও অনুদান দিয়েছেন। সেই সঙ্গে মেয়র হিসেবে প্রশিক্ষণেরও সুযোগ করে দিয়েছেন। এদের অধিকাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। সেই সঙ্গে নারীদের অগ্রিম সহযোগিতাও করেছেন ব্লুমবার্গ।
এছাড়া ব্লুমবার্গের পরিচালন দক্ষতা এবং শান্ত স্বভাব অনেকের কাছেই তাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তিনি ট্রাম্পকে হারানোর যোগ্যতা রাখেন এমন ধারণাও অনেকে করছেন। ফলে ট্রাম্প ও ব্লুমবার্গের মধ্যে কে বেশি সম্পদশালী তা নিয়েও চলছে আলোচনা। তিনি অসদুপায় কিংবা অন্যায়ভাবে রাজনৈতিক সুবিধাও কিনে নিতে পারবেন! কিন্তু ট্রাম্প হচ্ছেন এমন উদ্বেগজনক চরিত্র যার ত্রুটিগুলো অনেক ভোটার উপেক্ষা করারও চিন্তা করতে পারে! অন্য কোথাও আমেরিকার মানুষ এমন ভুল জীবনেও ক্ষমা করতো না। এসব কারণেই ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচন একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্যও একটা যুদ্ধ।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনূদিতঅনুবাদ : সাখাওয়াত হোসেন সুজন
এসএইচএস/পিআর