ডা. আব্দুন নূর তুষার। আলোচক, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। জন্ম ঢাকায়, পড়াশোনা করেছেন ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে। চাকরি করেছেন হাইপারটেনশন সেন্টার, ইউএসএইড’র বেসিকস প্রকল্পে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে। মানসিক চিকিৎসায় উচ্চতর শিক্ষাকালীন সরকারি চাকরির জটিলতায় বিরক্ত হয়ে চাকরি ছেড়ে টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণ ও উপস্থাপনা করছেন।
Advertisement
করোনাভাইরাস, আতঙ্ক, করণীয় এবং বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবা নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : করোনাভাইরাসে কাঁপছে বিশ্ব। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আগেও দেখেছে মানুষ। এইচআইভি ভাইরাস মোকাবিলা করেই বেঁচে থাকার পথ খুঁজছে মানবজাতি। কিন্তু করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে আতঙ্কিত সবাই। এ ভয়াবহতা নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ কী?
আব্দুন নূর তুষার : কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে ভাইরাসজনিত রোগ আছে। ধারণা করা হয়, অ্যান্টারটিকার বরফের গভীর স্তরে প্রচুর ভাইরাস আটকে আছে, যা কখনই বেরিয়ে আসেনি। সেখানকার বরফ তো গলতে শুরু করেছে। গবেষকরা ধারণা করছেন, এতে পৃথিবী নতুন করে আরও ভাইরাস দেখতে পাবে। এ ভাইরাসগুলোকে বলা হয় লার্জ বা জায়ান্ট ভাইরাস। কারণ এগুলোর আকৃতি বিশাল এবং জীবনকালও দীর্ঘ।
Advertisement
ভাইরাসজনিত রোগের সঙ্গে মানুষের পরিচিতি দীর্ঘদিনের। গুটিবসন্ত, জলবসন্ত ভাইরাসজনিত রোগ। পোলিও রোগও ভাইরাসের কারণে। এই রোগগুলো টিকা দিয়ে মোকাবিলা করা হচ্ছে। এইচআইভি ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে কিছু ওষুধও আছে। এইডস রোগীদেরও ওষুধ দেয়া হচ্ছে। এসব ওষুধের কারণেই মানুষ এইডস নিয়ে অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারছে, যা আগে পারেনি।
জাগো নিউজ : ভাইরাসজনিত রোগ মোকাবিলার অভিজ্ঞতা মানুষের আছে। তাহলে করোনাভাইরাসে এত আতঙ্ক কেন?
আব্দুন নূর তুষার : এমন আতঙ্ক হতে দেখে আমি অবাক হচ্ছি। ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আগেই যদি আতঙ্কিত হয়ে মৃত্যুর আগেই মরে যাই— এর তো কোনো মানে হয় না। করোনাভাইরাস নিয়ে এত আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই এই জন্য যে, এর চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল সার্স ও মার্স ভাইরাস। অসংখ্য ভাইরাস রয়েছে, তার মধ্যে ১৬ রকমের ভাইরাসের টিকা আছে। কিছু ফ্লু ভাইরাস নিয়মিতভাবে তার চেহারা বদলায়। এগুলোর অনেকগুলোর টিকা এখনও আবিষ্কার হয়নি। যেমন- বার্ড-ফ্লু ও সোয়াইন-ফ্লু। সোয়াইন-ফ্লুতে আক্রান্তদের মধ্যে দশ ভাগের মৃত্যু ঘটেছে। তুলনা করলে দেখা যাবে, করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা দুই বা তিন শতাংশ। তার মানে, করোনাভাইরাস ওই ভাইরাসগুলোর মতো ভয়ঙ্কর নয়।
জাগো নিউজ : তাহলে করোনাভাইরাস নিয়ে এত হইচই কেন?
Advertisement
আব্দুন নূর তুষার : এর নানা রকম ব্যাখ্যা আছে। মানুষকে সতর্ক করা ভালো। কিন্তু মানুষ আতঙ্কিত হয়ে যেভাবে মাস্ক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা অনেকটাই হাস্যকর। যে মাস্ক ভাইরাস ঠেকাতে পারে না, তার দামও বেড়েছে দশগুণ।
জাগো নিউজ : আতঙ্কিত হওয়ার কারণও আছে। দুই হাজারের অধিক মানুষ মারা গেল। প্রচুর আক্রান্ত হচ্ছে…
আব্দুন নূর তুষার: আমি মৃত্যুর হারের তুলনা করেছি। শতকরা কতজন মানুষ মারা গেছে করোনায়? ডেঙ্গুতেও মৃত্যুর হার প্রায় এমনই। মশা তো উড়ছেই। তাই বলে আপনি কি মশার ভয়ে ঘরের মধ্যে বসে আছেন?
মূলত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিতে হবে। আতঙ্কিত হয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় না।
জাগো নিউজ : তুলনা করে বলছেন, বটে। কিন্তু করোনাভাইরাসের ব্যাপকতা অন্য ভাইরাসের চেয়ে বেশি কি-না?
আব্দুন নূর তুষার : এই ভাইরাসগুলো একই গোত্রীয়। করোনাভাইরাস দেখতে মুকুটের মতো। উহান শহর থেকে এটা ছড়িয়ে পড়ার পর আমার কাছে মনে হয়েছে, চীন অতিমাত্রায় কথা বলেছে এটি নিয়ে। এ কারণেই মানুষ বেশি আতঙ্কিত হয়েছে।
জাগো নিউজ : তাদের (চীন) বেশি কথা বলার কারণ কী?
আব্দুন নূর তুষার : ভাইরাস নিয়ে এত কথা বলার মধ্য চীন দেখাতে চেয়েছে যে, দশ দিনের মাথায় বিশাল একটি হাসপাতাল বানাতে পারে তারা। তারা মূলত নিজ শক্তিমত্তা দেখাতেই বেশি ব্যস্ত।
চীনের গণমাধ্যমও হাসপাতাল তৈরির খবর নিয়ে ব্যস্ত হলো। প্রথম দশ দিন ভাইরাসের চেয়ে বেশি গল্প হয়েছে চীনের নির্মাণকাজের উৎকর্ষ নিয়ে। লাখো মানুষ আক্রান্ত। দুই হাজার বা ১০ হাজার জনের হাসপাতাল দিয়ে কী হবে? আর এটিকে আপনি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালও বলতে পারেন না। তাৎক্ষণিকভাবে আইসোলেশন সুবিধা দেয়ার জন্যই এমন হাসপাতাল বানানো হয়।
যে ভাইরাসের টিকা নেই সে ভাইরাস থেকে হওয়া রোগের জন্য আইসোলেশন সুবিধাই দেয়ার নিয়ম। অন্য হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় না এমন রোগীদের। ছোঁয়াচে বলে প্রাদুর্ভাব আরও বাড়তে পারে। মৃত্যুর হার বাড়তে পারে। সংক্রামক ব্যাধির রোগীদের সেবা দিতেই এ বিশেষ ব্যবস্থা।
এমন হাসপাতাল চীনের মতো দেশের পক্ষে ১০ দিনে বানানো সম্ভব। এসব হাসপাতালের কাঠামো অনেকটাই তৈরি করা থাকে। শুধু সংযুক্ত করা হয়।
জাগো নিউজ : এসবের মধ্য চীন আসলে কী বোঝাতে চাইছে?
আব্দুন নূর তুষার : চীন বোঝাতে চাইছে যে, তারা খুবই শক্তিশালী। করোনাভাইরাস আজ আছে, কাল থাকবে না। কিন্তু চীনের এই প্রযুক্তি, হাসপাতাল বানানোর অভিজ্ঞতা সারাবিশ্বে বিক্রি করতে পারবে। এমন হাসপাতাল তৈরির মধ্য দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করবে।
জাগো নিউজ : করোনাভাইরাস নিয়ে একধরনের লুকোচুরির কথাও শোনা যাচ্ছে। পশ্চিমা মিডিয়ায় যে খবর মিলছে, তা চীনের মিডিয়ায় মিলছে না…
আব্দুন নূর তুষার : হঠাৎ করে এমন রোগ মহামারি আকারে দেখা দিলে ভিন্ন ভিন্ন চিত্র মেলে। এর আগেও পৃথিবীতে এমন বিভাজনের খবর পাওয়া গেছে।
পুঁজিবাদী বিশ্বের চরিত্রই এটি। যেকোনো সংকটকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করতে চায়। বাংলাদেশে যারা মাস্ক ব্যবসা করেন তারা মজুত করে রেখে দোয়া পড়ছেন, যেন বাংলাদেশে করোনাভাইরাস চলে আসে। এতে তাদের ব্যবসা ভালো হবে। কারণ ভাইরাস না এলে তো তাদের মজুতদারি সফল হবে না।
জাগো নিউজ : কিন্তু চীন তো ক্ষতির সম্মুখীনও। আক্রান্ত প্রদেশগুলো বিচ্ছিন্ন প্রায়। অন্য দেশেও চীনের ব্যবসায় ভাটা পড়েছে…
আব্দুন নূর তুষার : এগুলো বাইরের খবর। ভেতরে খবর এত জটিল নয়। আলিবাবাতে যান। দেখেন চীনের ব্যবসায়ীরা পণ্য সরবরাহ করছে কি-না। এ সংকট চীনের জন্য সাময়িক। চলে যাবে।
জাগো নিউজ : ভাইরাস সংক্রমণে মানবজাতি কতটুকু ঝুঁকির মধ্যে আছে? এর শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা কী?
আব্দুন নূর তুষার : ভাইরাসের কারণে মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে— এমন ভাবনা ভুল বলে মনে করি। ভাইরাসে মারা যাচ্ছে, মানুষ এ নিয়ে চিন্তিত নয়। কারণ ভাইরাসে যত মানুষ মারা গেছে, গত এক হাজার বছরে তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে যুদ্ধে।
মানুষ যুদ্ধ বন্ধ করছে না। ভাইরাসে নয়, যুদ্ধের কারণে মানবজাতি নির্মূল হতে পারে। অজানা রোগের কারণে মানবজাতি ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। মানবসৃষ্ট কারণ অথবা মহাজাগতিক কোনো দুর্ঘটনার কারণে মানুষ নির্মূল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ভাইরাসের আক্রমণে নিঃশেষ হওয়ার ঝুঁকি থেকে বেশি।
জাগো নিউজ : বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি ও মোকাবিলা নিয়ে কী বলা যায়?
আব্দুন নূর তুষার : বাংলাদেশ আসলে এমন ঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষমতাই রাখে না। বাংলাদেশকে আল্লাহর করুণার ওপর ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতে হয়। বাংলাদেশ চীনের মতো আইসোলেশন হাসপাতাল তৈরি করবে কোথায়? আমাদের না আছে জায়গা, না আছে চলাচলের ব্যবস্থা। যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। মনে করেন, একজন রোগী ঘণ্টায় একটা হাঁচি দেয়। তার মানে, দুই ঘণ্টা তার সাথে একই বাসে থাকা মানে দুবার হাঁচির মুখোমুখি হওয়া। এখানে এই ভাইরাস এলে কেবল ঘনবসতির জন্য আমরা বিপদে পড়ব। কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে মানুষকে সেবা দেয়ার উপায় নেই।
যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া। ছোট বোনকে বাঁচাতে বড় বোনের আপ্রাণ চেষ্টা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ছবিটি তোলা
জাগো নিউজ : তাহলে মোকাবিলার যে আয়োজন, তা কী মূলত লোক দেখানো…
আব্দুন নূর তুষার : লোক দেখানো বলছি না। সরকার তার সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। বৃষ্টি এলে ধনী লোকটি তার জানালা বন্ধ করে, আর বস্তিতে থাকা গরিব লোকটিও তার ঘরের পলিথিনটা ঠিক করে। প্রতিরক্ষার চেষ্টা করে দুজনই। বাংলাদেশ তাই তার যতটা সাধ্য ততটা করছে।
জাগো নিউজ : তার মানে, বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা বৃষ্টির বেলায় পলিথিনের ঘর ঠিক করার মতো?
আব্দুন নূর তুষার : অনেকটা তা-ই। কারণ এমন ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে প্রতিরোধের মতো সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। অর্থাৎ করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সক্ষম নয়।
ধরুন, সরকারি-বেসরকারি মিলে হাসপাতালের বেড আছে এক লাখ ত্রিশ হাজারের মতো। এক লাখ মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাদের কোথায় জায়গা দেবে? অন্য রোগীদের কোথায় সেবা দেবে? যদিও বাংলাদেশ পোলিও, হাম, বসন্ত, ম্যালেরিয়া মোকাবিলা করে সফলতার সাক্ষর রেখেছে। কিন্তু করোনা মহামারি হিসেবে দেখা দিলে বাংলাদেশ সামাল দিতে পারবে, এটি জোর দিয়ে বলার উপায় নেই।
এএসএস/এমএআর/জেআইএম