দেশবরেণ্য কিংবদন্তী অভিনেতা গোলাম মুস্তাফা। অভিনয়ে, কণ্ঠে তিনি ছিলেন অনবদ্য একজন। ছোট কিংবা বড়- দুই পর্দাতেই তাকে দেখতে মুখিয়ে থাকতেন দর্শক। একজীবনে বহু চরিত্রে তিনি দাগ কেটেছেন সবার অন্তরে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের গুণি এই অভিনেতা ২০০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন।
Advertisement
আজ তার ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তাকে স্মরণ করছেন ভক্ত-অনু্রাগীরা।
গোলাম মুস্তাফা ২ মার্চ ১৯৩৪ সালে বরিশালের দপদপিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার বাবা ছিলেন সাব-রেজিস্ট্রার। স্কুল জীবন শুরু করেন তিনি ‘রোজপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে’। ম্যাট্রিক পাস করেন ‘খুলনা জিলা স্কুল’ থেকে। স্কুল-কলেজ জীবনে নাটকে অভিনয় করা তাঁর শখ ছিল।
১৯৪৫ খৃষ্টাব্দে বরিশাল অশ্বিনী কুমার টাউন হল মঞ্চে বি.ডি হাবিবুল্লাহ রচিত ‘পল্লীমঙ্গল’ নাটকে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। একই বছর বরিশাল জেলা স্কুলে ‘ফাতেহা ইয়াজ দাহাম’ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘ঐ নাম’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন এবং আবৃত্তিকার হিসেবে তিনি দর্শকদের নজর কাড়েন।
Advertisement
পঞ্চাশের দশকের মধ্য সময়ে ঢাকায় আসেন এবং নাট্যাভিনয় শুরু করেন গোলাম মুস্তাফা। তিনি প্রথমে চিত্রজগতে আসেন প্রামাণ্যচিত্র ‘এক একর জমি’তে অভিনয়ের মাধ্যমে। প্রথম অভিনীত ছবি এহতেশাম পরিচালিত ‘রাজধানীর বুকে’। ১৯৬০ খৃষ্টাব্দে মুক্তি প্রাপ্ত এই ছবিতে তিনি ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করেন। মূলতঃ প্রথম ছবি থেকেই তিনি অভিনয়ে পারদর্শিতা দেখান। এরপরে নায়ক, সহনায়ক, খলনায়কসহ বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন।
গোলাম মুস্তাফা বাংলা ও উর্দু মিলে প্রায় তিনশতাধীক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রসমূহ হচ্ছে- হারানো দিন, চান্দা, নাচঘর, পীরিত না জানে রীত, কাজল, ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো, ‘তালাশ, আলিবাবা চল্লিশ চোর, বন্ধন, বেগানা, কারওয়াঁ, ক্যায়সে কহু, নদী ও নারী, কার বউ, ইস্ ধরতি পর, ইন্ধন, চাওয়া পাওয়া, দাসী, সোহানা সফর, নতুন দিগন্ত, গোরী, ভাইয়া, প্রতিকার, দুই রাজকুমার, বলাকা মন, বিনিময়, সন্তান, নিজেরে হারিয়ে খুঁজি, রং বদলায়, সোনার খেলনা, কে আসল কে নকল, মিশর কুমারী, রক্তাক্ত বাংলা, তিতাস একটি নদীর নাম, সূর্যসংগ্রাম, ধীরে বহে মেঘনা, শ্লোগান, সীমানা পেরিয়ে, সারেং বৌ, পদ্মা নদীর মাঝি, মমতা, পিঞ্জর, বন্দিনী, আলোর পথে, দম মারো দম, ফকির মজনু শাহ, রূপালী সৈকতে, কার পাপে, ছোট মা, ঈমান, সখি তুমি কার, লুটেরা, মোকাবেলা, রাজনন্দিনী, জংলীরাণী, গাংচিল, অভিযোগ, আনারকলি, স্বামী, কলমীলতা, আকাশ পরি, টক্কর, লালু ভুলু, প্রাণ সজনী, নাজমা, জালিম, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, দেবদাস, শক্তি, চন্দ্রনাথ, সুখ দুখের সাথী, লক্ষ্মীবধূ, হিসাব নিকাশ, শুভদা, দোষী, অন্যায়, সুরুজ মিঞা, অবিচার, ব্যথার দান, রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত, স্ত্রী, আশা ভালোবাসা, জীবন সংসার, শ্রাবণ মেঘের দিন, ইত্যাদি।
গোলাম মুস্তাফা, ঢাকা টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকে নাটকে অভিনয় শুরু করেন। প্রথমদিকে ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি নাটকে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তিনি তাঁর সহকর্মী অভিনেত্রী হোসনে আরার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার মেয়ে সুবর্ণা মুস্তাফা একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী।
গোলাম মুস্তাফা ১৯৮০ খৃষ্টাব্দে ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য, শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্র অভিনেতা এবং ১৯৮৬তে, ‘শুভদা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। অভিনয়শিল্পে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘একুশে পদক- ২০০১’ ভুষিত হন। তিনি বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক অসংখ্য সম্মাননা লাভ করেন।
Advertisement
গোলাম মুস্তাফা একজন জনপ্রিয় আবৃত্তিকার ও লেখকও ছিলেন। বিভিন্ন সাময়িকীতে আধুনিক চলচ্চিত্র ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে নিবন্ধ লিখেছেন। তিনি কর্নেল মেইগস রচিত ‘ফেয়ার উইন্ড টু ভার্জিনিয়া’ গ্রন্থের সুপাঠ্য অনুবাদ করেন। ইউসিস, ঢাকা প্রকাশিত এ অনুবাদ গ্রন্থটির বাংলা নাম ‘নতুন যুগের ভোরে’। তার অনেক অনুবাদকর্ম বিভিন্ন সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
এলএ/এমএস