মতামত

ফেসবুকের বিচিত্র ফ্রেন্ডস

আমি একজন ভাইস চ্যান্সেলরকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম। তিনি আমার পরিচিত। সাধারণত আমি অপিরিচিত লোকের কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই না। উনার সঙ্গে আমার ফেবু ম্যাসেনজারে কথা আদান প্রদান হয়- এমনই পরিচিত ব্যক্তি তিনি। অনেকদিন পড়ে ছিল আমার রিকোয়েস্ট। তিনি গ্রহণ করেননি। এক সময় আমি তুলে নেই। অবশ্য রিকোয়েস্ট গ্রহণ করা নিয়ে আমাদের মধ্যে সামনা-সামনি, বা ম্যাসেনজারেও কোনোদিন কথা হয়নি। আমার একটু খারাপ লেগেছিল বটে তার এই আচরণ। কারণ উনার বন্ধু তালিকার অনেকের চেয়ে আমার সামাজিক মর্যাদা খারাপ না। উনার সঙ্গে আমার সম্পর্কও বৈরি নয়।ভিসি সাহেব ফেসবুকে উনার বন্ধুদের তালিকাও হেফাজত করেননি। খুলে রেখেছেন সবার জন্য। ঢাকা শহরের এমন কোনো নামকরা পার্টি-গার্ল নেই তার ফেবু ফ্রেন্ডস তালিকায় নেই। দু’চার জন চিহ্নিত ‘হোর’ও আছে। যাই হোক, কে কার সঙ্গে বিছানায় যাবে, হজে যাবে, কারসঙ্গে টক শোতে যাবে, এবং কাকে ফেবু ফ্রেন্ড করবে- এসবই আসলে একান্ত ব্যাপার। এই নিয়ে মনে কষ্ট পাওয়া উচিত নয়। এটা আমি অনেক আগেই মেনে নিয়েছি।সত্যি কথা বলতে আমিওতো এমন অনেককে লিস্টে রাখি না। কাতর অনুরোধের পরও বিশেষ বিশেষ কারণে অনেককে লিস্টে রাখিনি। শুরুর দিকেতো এমনই গোঁড়া ছিলাম যে যার সঙ্গে জীবনে কোনো দিন দেখা হয়নি এমন লোককে ফ্রেন্ডস লিস্টে রাখবো না সিদ্ধান্ত ছিল। পরে তা আংশিক পরিবর্তন হয়েছে। শুধু তাই নয় এখন আমি দুটা একাউন্ট চালাচ্ছি- যাতে অপরিচিত বন্ধুরাও ‘আমি আপনার শুভাকাঙ্খি, লিস্টে জায়গা পাচ্ছি না কেন’- বলে বিব্রত করতে না পারে। তবে অপরিচিত হলে যারা উদ্ভট নাম, মানুষের ছবি ছাড়া প্রোফাইল, অন্যের ছবি বা ছবিহীন একাউন্ট থেকে রিকোয়েস্ট পাঠান তাদেরকে ফ্রেন্ড লিস্টে নিতে পারি না।নিজের চরম দোষ কিন্তু আমরা দেখি না। কত জনকে যে বিনা কারণে ব্লক লিস্টে রেখেছি সেটার তালিকাওতো অনেকের ফ্রেন্ডস লিস্ট থেকে দীর্ঘ। এক ক্লাসমেট বললো আমি তোকে ফ্রেন্ডস লিস্ট থেকে বাদ দিয়েছি। আমি জানতে চাইলাম দোষটা কি? কোনো সদুত্তর নেই। আমি বললাম তুই যদি অকারণে বাদ দিতে পারিস, আমি তোকে ব্লক করলে সমস্যা কি! এখনো সে ব্লক আছে। একজন আমাকে তার বিয়ের দাওয়াত দেয়নি। দিলেও যেতে পারতাম না। কারণ তখন আমি ঢাকার বাইরে। তাকে ব্লক মেরেছি। যার সঙ্গে বছরের পর বছর সংগঠন করেছি, একসঙ্গে পেশাগত কাজ করেছি- সে যদি যদু মধুকে তার বিয়ের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিতে পারে, আমাকে নয় কেন! আর বাস্তব জীবনেই  যে  বন্ধু হিসেবে গণ্য করে না এমন লোককে বন্ধু লিস্টে রাখার দরকার কি! আমাকেই বা সে এড করেছে কেন!সেদিন আমার লেখা একটা কলাম ফেসবুকে শেয়ার করলে একজন বিরুপ মন্তব্য করেন। বিরুদ্ধ-মত নেওয়ার ক্ষমতাটা আমার বিচিত্র। যদি সে আমার পরিচিত হয় বিরুদ্ধ মত আমি স্বাভাবিকভাবে নেই। যুক্তি দিয়ে তাকে জবাব দেই। আমরা পরস্পরকে চিনি বলে বিষয়টার সমাধানও হয়- যতই তীব্র বাক্য বিনিময় হোক না কেন বা সে যতই কোনো একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের অন্ধ সমর্থক হোক, সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় অপরিচিতদের অযাচিত মন্তব্য হজম করা নিয়ে।সেক্ষেত্রে আমি তার ফেসবুক ওয়াল দেখি। বাঁশেরকেল্লা জাতীয় পোস্ট শেয়ার করা দেখলে তার সঙ্গে তর্কে না গিয়ে কমেন্ট ডিলিট করে দেই। তাকেও বের করে দেই। কেউ ম্যাসেনজারে অভিযোগ করলে জবাবও দেই- যেহেতু আমাদের মতের মিল হবে না বন্ধু না থাকাই উত্তম। সেদিনও আমার পোস্টে এমন বিরুপ মন্তব্যকারীকে কমেন্ট ডিলিট করে ফ্রেন্ডস লিস্ট থেকে বাদ দেই। ক্ষিপ্ত ব্যক্তি ইনবক্স করলেন যে, আমার সাহস নেই তাই তার জবাব না দিয়ে মন্তব্য ডিলিট করেছি। আরও বললেন, ‘আমি শাহবাগীদের ঘৃণা করি’। অদ্ভুত চরিত্র মানুষের। শাহবাগীদের ঘৃণা করেন অথচ বন্ধু তালিকায় থাকবেন শাহবাগ-প্রেমিদের। ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে বাদতো দিলামই। ব্লক করার কাজটিও সারলাম। কার এই ধৈর্য আছে তর্কে তর্কে সময় নষ্ট করার।তর্কতে বাঁশেরকেল্লা পার্টি যেমন আছে তেমনি বেশি বেশি চেতনাজীবীরা কম যান না। এদের অনেকের সমস্যা হচ্ছে এরা ফেসবুক স্ট্যাটাস আর ব্লগের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে চান না। আমি আমার কোনো বন্ধুর ওয়ালে তার স্ট্যাটাসে মন্তব্য করলাম- মাঝপথে এরা এসে বকাঝকা শুরু করবে, আমার বন্ধু না হয়েও, আমাকে না চিনেও- এটা নিশ্চয়ই শোভনীয় নয়। বিষয়টা যে আমার এবং আমার বন্ধুর মধ্যে, আমাদের বক্তব্যের মধ্যে ‘বিটিউইন দ্যা লাইন’ কিছু থাকতে পারে, যেটা আমরা একে অপরকে চিনি বলে প্রকাশ্যে বলার দরকার নেই, কে কোন কারণে কি বলছি সেটাও জানি- এরা এসব মানতে চায় না। আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে এসেছি তার সঙ্গে হয়তো নয়-  সেটাও মানতে চান না। একজন ব্লগার যখন তার ব্লগ লিখবেন, মন্তব্য নিবেন কি নিবেন না তার ব্যাপার। মন্তব্য নিলে সেখানে পরিচিত-অপরিচিত সবার মতামত রাখার সুবিধা থাকে। জবাবদানেরও সুবিধা থাকে। ফেসবুকের সঙ্গে এখানে সূক্ষ পার্থক্য রয়েছে। কারণ ফেসবুকে আমরা সবাইকে বন্ধু করি না, স্ট্যাটাস দেখাই না, সবাইকে মন্তব্য করার সুযোগও দেই না। ব্লগ সাইটে বন্ধু বলে কিছু নেই। সেখানে সবাই সবার কাছে ওপেন। কিছুদিন আগে একজন নারী ব্লগারকে ফেসবুকে সিপি গ্যাং নামের একটি সংগঠনের অনুসারিরা সাইবার বুলিং করেছে বলে হৈ চৈ হল ফেসবুকে। আমি সাইবার বুলিং সমর্থন করি না। এসব মেনে নেওয়া কঠিন। ওই ঘটনার নেপথ্যে কে রয়েছে তারও অনেক গবেষণা হয়েছে দেখলাম। কিন্তু যারা গবেষণা করলেন তারা এটা কেন দেখলেন না তিনি তার ওয়াল খুলে রেখেছেন সবার মন্তব্য পাওয়ার জন্য, শুধু বন্ধুদের না। উনার বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য গেলে উনি তাকে আনফ্রেন্ড করে অন্যদের দিয়ে একই কায়দায় বুলিং করিয়েছেন অতীতে। উনি নারী বলে উনাকে যখন কেউ বুলিং করে তখন সেটা হয় ‘সাইবার ধর্ষণ’, অন্যদের বেলায় হয় মন্তব্যের জবাব। যাই হোক, এ কাহিনী বলার অর্থ অপরিচিতদের যখন বন্ধু তালিকায় রাখলে, মন্তব্যের সুযোগ রাখলে- তখন এটা হতে বাধ্য। আগে পোস্টের মন্তব্যকারী নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ার আগে আমি কাকে বন্ধু করবো তাও ভাবা দরকার। ব্যক্তিগতভাবে আমি বাঙালিয়ানা, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ- এই তিন প্রশ্নে কোনো আপস করি না। এর সঙ্গে আমার রাজনীতির সম্পর্ক নেই। রাজনীতির প্রশ্নে আমি উদার। এটা আমার আত্মপরিচয়। আমার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর ভালোলাগার বিষয়। কারও আত্ম-পরিচয় যদি অন্যটা হয় তাহলেও সমস্যা নেই, শুধু আমার বিশ্বাস নিয়ে গুতাগুতি এবং তার বিশ্বাস আমার উপর চাপাতে না চাইলেই হল।উনি কোন্ দল করেন, দল না করেন, তার নেতা কে- তা নিয়েও আমার সমস্যা নেই। আস্তিক না নাস্তিক, কোন্ ধর্মের লোক- সেটাও আপনার বিষয়। আমার ওয়ালে তার প্রচার না করে, মাত্রার মধ্যে থেকে যার যার ওয়ালে প্রচার করলেই হল। কিছু ফ্রেন্ড আছেন ট্যাগ মারাতে ওস্তাদ। উনার সব পোস্ট আমাকে ট্যাগ করতে হবে কেন! আমার সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন বিষয়ে আমাকে ট্যাগ করার দরকার কি!তবে হত্যা-নৈরাজ্য, যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থনে যারা ফেসবুক ব্যবহার করেন- তারা আমার লিস্টে থাকেন, চাই না। যাদের এসব মানতে সমস্যা তারা আমার ফ্রেন্ড লিস্টে না থাকলেও সমস্যা নেই।সব শেষে বলি, ফেসবুক আজ এক শ্রেণির যৌনকাতর লোকদেরদের চাহিদা পূরণের টুলসও হয়েছে। এখানে নারী-পুরুষ পার্থক্য নেই। প্রেম নিবেদনও দু’তরফ থেকে আসে। ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে এদেরকেও দূরে রাখা দরকার। রাখার চেষ্টা করছি।লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষকanisalamgir@gmail.comএইচআর/পিআর

Advertisement