ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ (ব্রেক্সিট) কার্যকরের পর নতুন অভিবাসন বিষয়ক পরিকল্পনা অনুযায়ী কম দক্ষতা সম্পন্ন কর্মীরা আর দেশটির ভিসা পাবেন না বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। বিবিসির বুধবারের এক প্রতিবেদনে এ খবর জানানো হয়েছে।
Advertisement
প্রতিবেদন অনুযায়ী, কর্মী নিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বরিস জনসনের সরকার আহ্বান বলেছে, ইউরোপ থেকে আসা সস্তা শ্রমিকের ওপর নির্ভর না করে কর্মী ধরে রাখা এবং অটোমেশন প্রযুক্তি উন্নয়নের ওপর যেন জোর দেন তারা। ব্রেক্সিট কার্যকর এখনো হয়নি। তবে আগামী বছরের শুরু থেকে তা কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে।
ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র অধিদফতর জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও এর বাইরের যেসব নাগরিক যুক্তরাজ্যে আসতে চান, তাদের ৩১শে ডিসেম্বর ইউকে-ইইউ ফ্রি মুভমেন্ট বন্ধ হওয়ার পর একই মাপকাঠিতে যাচাই করা হবে। বিরোধীদল লেবার পার্টি বলছে, এর ফলে তৈরি প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে দেশে শ্রমিক পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিতি প্যাটেল বলেছেন, ‘এই নতুন ব্যবস্থার কারণে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও শ্রেষ্ঠরাই যুক্তরাজ্যে আসার সুযোগ পাবেন।’ সরকার বলছে, তারা সার্বিকভাবে যুক্তরাজ্যে অভিবাসীদের আগমন কমানোর চেষ্টা করছে। নিজেদের নির্বাচনী তফসিল অনুযায়ী একটি পয়েন্টভিত্তিক অভিবাসন ব্যবস্থা তৈরি করতে চায় তারা।
Advertisement
নতুন এই ব্যবস্থা অনুযায়ী, যেসব বিদেশী কর্মী যুক্তরাজ্যে যেতে চান তাদের ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারতে হবে এবং অনুমোদিত পৃষ্ঠপোষকের (স্পন্সর) অধীনে দক্ষতা সম্পন্ন কোনো চাকরিতে নিয়োগ পেতে হবে। তা নিশ্চিত করতে পারলেই তারা পাবেন ৫০ পয়েন্ট।
যুক্তরাজ্যে কাজ করার অনুমতি পেতে হলে সব মিলিয়ে অভিবাসীদের ৭০ পয়েন্ট নিশ্চিত করতে হবে, যার মধ্যে যোগ্যতা, বেতন ও যে খাতে কর্মীর অভাব রয়েছে এমন কোনো খাতে কাজ করলেও পয়েন্ট পাওয়া যাবে। তবে সরকার জানিয়েছে, কম দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিকদের অভিবাসনের জন্য পথ তৈরি করবে না তারা।
ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আহ্বান জানিয়ে সরকার বলেছে, তারা যেন ইইউ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে বাধাহীন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টির সঙ্গে খাপ খাইয়ে ও সমন্বয় করে নেয়। নিয়োকর্তারা যুক্তরাজ্যের অভিবাসন পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল না থেকে যেন কর্মী ধরে রাখা, উৎপাদনশীলতা ও প্রযুক্তির উন্নয়নে বিনিয়োগ করে।
ব্রিটিশ সরকার মনে করে, নতুন কর্মী না বাড়িয়ে যে ৩২ লাখ ইইউ নাগরিক যুক্তরাজ্যে থাকার অনুমতি চেয়েছেন, তাদের দিয়ে শ্রমজাবারের চাহিদা মেটানো যেতে পারে।পাশাপাশি, কৃষিখাতে মৌসুমী শ্রমিক নেয়ার অনুমোদিত পরিমাণ চারগুণ পরিমানে বাড়িয়ে তা ১০ হাজার করতে যাচ্ছে বরিস জনসনের কট্টর ব্রেক্সিটপন্থী সরকার। এছাড়া ‘ইয়ুথ মোবিলিটি অ্যাগ্রিমেন্ট’-এর অধীনে প্রতিবছর ২০ হাজার তরুণ যুক্তরাজ্যে যাওয়ার সুযোগ পাবে।
Advertisement
সিবিআই এই প্রস্তাবের অনেকগুলোর সমর্থন করলেও তারা মনে করে কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় কর্মী কীভাবে পাওয়া যাবে, তা চিন্তা করতে হিমশিম খাবে।
প্রতিষ্ঠানটির মহাসচিব ক্যারোলিন ফেয়ারবেয়ার্ন বলেছেন, ‘ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো জানে যে বিদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ দেয়া এবং কর্মীদের দক্ষতা ও প্রযুক্তি উন্নয়নে বিনিয়োগের মধ্যে কোনো একটি করলে হবে না—অর্থনীতির উন্নয়নে দুটিই একাধারে চালাতে হবে।
রয়্যাল কলেজ অব নার্সিং আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, এই প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়নে জনগণের স্বাস্থ্য ও সেবার চাহিদা পূরণ হবে না। সেবাখাতের সঙ্গে জড়িত ইউনিসনের সহ-সম্পাদক ক্রিস্টিনা ম্যাকেনা বলেছেন, এ ধরনের প্রস্তাব সেবা খাতের জন্য হবে বিধ্বংসী।
যুক্তরাজ্যের হোমকেয়ার অ্যাসোসিয়েশন কম দক্ষতা সম্পন্ন কর্মীদের জন্য সুযোগ কমিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে আখ্যা দিয়েছে। জাতীয় কৃষক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিনেট ব্যাটার্স ব্রিটেনের খাদ্য ও কৃষি খাতে প্রয়োজনীয়তা নির্ণয়ে ব্যর্থ হওয়ায় গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
আর খাদ্য ও পানীয় বিষয়ক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, নতুন এই প্রস্তাবের অধীনে মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ, বেকিং, পনির ও পাস্তা তৈরিকারী শ্রমিকরা অন্তর্ভূক্ত থাকবে না। নতুন অভিবাসন নীতিতে দক্ষ কর্মী বাড়ানোর পাশাপাশি কম দক্ষ শ্রমিকের হার কমানোয় সমন্বয় করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কিছু নিয়ম শিথিল হবে। যেমন শ্রমিকদের দক্ষতার নির্ধারিত মান না থাকা এবং সর্বনিম্ন বেতনের হার কম হওয়া। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত দেশগুলো থেকে যারা যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করতে চাইবেন তাদের জন্য নিয়ম কঠিন হবে।
দর্শনার্থীরা ভিসা ছাড়া ছয়মাসের জন্য থাকতে পারবেন, তবে কাজ করতে পারবেন না। যাদের দক্ষতা রয়েছে তাদের চাকরির অনুমোদন নিয়ে আসতে হবে এবং অভিবাসনের প্রয়োজনীয় ৭০ পয়েন্ট পেতে হবে। রেস্টুরেন্ট, হোটেল, সেবা খাতে এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় দক্ষতাহীন কোনো অভিবাসী চাকরি করতে পারবেন না।
নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, সব অভিবাসী অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্রিটেনে থাকার অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত আয় সংক্রান্ত সুবিধা ছাড়া অন্য কোনো সুবিধা পাবেন না।
বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাগরিকরা যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক সুবিধা চাইতে পারেন—যতদিন তারা অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় থাকেন। ইইউ’র বাইরের নাগরিকরা সুবিধা পাওয়ার যোগ্য হন তখনেই যখন তাদের যুক্তরাজ্যে বসবাসের অনুমতি দেয়া হয়, যা সাধারণত পাঁচ বছরের মধ্যেই হয়ে থাকে।
যুক্তরাজ্যে যেতে চাওয়া দক্ষ শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন ৩০ হাজার পাউন্ড থেকে নামিয়ে ২৫ হাজার ৬০০ পাউন্ড করা হবে। অভিবাসন বিষয়ক পরামর্শক সংস্থা মাইগ্রেশন অ্যাডভাইসরি কমিটির তালিকায় এ মুহুর্তে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, মেডিকেল প্র্যাকটিশনার, নার্স, সাইকোলজিস্ট ও ব্যালে নৃত্যশিল্পীদের চাকরির সুযোগ রয়েছে।
নতুন প্রস্তাবের অধীনে, যুক্তরাজ্যে যাওয়া দক্ষ কর্মীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়ার বিষয়টি থাকবে না। এছাড়া শ্রমিকদের দক্ষতার সংজ্ঞাও পরিবর্তন করা হবে। যারা এ-লেভেল পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন তাদের স্বীকৃতি দেয়া হবে, যেটি আগে স্নাতক পর্যায়ে দেয়া হতো।
তবে দক্ষ শ্রমিকের তালিকা থেকে হোটেল ও রেস্টুরেন্টের ওয়েটারের চাকরি বাদ গিয়ে কাঠমিস্ত্রী, রাজমিস্ত্রী ও দক্ষ শিশু অভিভাবকের পদ যুক্ত হবে।
যুক্তরাজ্যে পড়ালেখা করতে চাইলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়া লাগবে। জানা লাগবে ইংরেজি। তারা নিজেরা নিজেদের আর্থিকভাবে সহায়তা করতে পারবে, এমন সক্ষমতাও দেখাতে হবে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এসএ/এমএস