ফিচার

জেনে নিন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বন্ধ করার উপায়

রক্তক্ষরণজনিত এক বিরল জেনেটিক রোগ হলো হিমোফিলিয়া। শরীরে কোথাও কেটে গেলে রক্তক্ষরণ বন্ধ হওয়ার জন্য রক্ততঞ্চন শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। রক্ততঞ্চনের জন্য স্বাভাবিকভাবেই অণুচক্রিকাসহ অনেকগুলো উপাদান জড়িত থাকে। এমন দুটি উপাদান হলো- ফ্যাক্টর ৮ ও ফ্যাক্টর ৯। হিমোফিলিয়ায় শরীরে এ দুটির যেকোনো একটি (প্রধানত ফ্যাক্টর ৮) অস্বাভাবিকভাবে কম তৈরি হয়। ফলশ্রুতিতে রক্ততঞ্চনে স্বাভবিকের চেয়ে বেশি সময় প্রয়োজন হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির কোথাও কেটে গেলে অস্বাভাবিকভাবে বেশি সময় নিয়ে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।

Advertisement

হিমোফিলিয়া কী: হিমোফিলিয়া প্রধানত এক্স লিঙ্কড রিসেসিভ বংশানুক্রমজনিত জেনেটিক রোগবিশেষ।

ধরন: হিমোফিলিয়া প্রধানত ২ ধরনের হতে পারে- হিমোফিলিয়া এ (ফ্যাক্টর ৮ এর অস্বাভাবিক কম পরিমাণ) এবং হিমোফিলিয়া বি (ফ্যাক্টর ৯ এর অস্বাভাবিক কম পরিমাণ)। এছাড়া হিমোফিলিয়া সি (ফ্যাক্টর ১১ এর পরিমাণ কম থাকে), প্যারাহিমোফিলিয়া (ফ্যাক্টর ৫ এর পরিমাণ কম থাকে), লব্ধ বা অর্জিত হিমোফিলিয়া এ এবং লব্ধ বা অর্জিত হিমোফিলিয়া বি।

কারণ: প্রতি ১০ হাজার জনের মধ্যে ১ জন (প্রতি ৫ হাজার ছেলেশিশুর মাঝে ১ জন) হিমোফিলিয়া এ এবং প্রতি ৪০ হাজার জনের মধ্যে ১ জন হিমোফিলিয়া বি দ্বারা আক্রান্ত হয়। এছাড়া ক্যান্সার, অটোইমিউন রোগ, মাল্টিপল স্কলেরোসিস, গর্ভাবস্থা প্রভৃতি কারণে লব্ধ বা অর্জিত হিমোফিলিয়া হয়ে থাকে। হিমোফিলিয়া এ এবং বি এর ক্ষেত্রে প্রধানত ছেলেরাই বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। মেয়েদের ক্ষেত্রে মেয়েরা বাহক হিসেবে কাজ করে। হিমোফিলিয়ার কোনো লক্ষণ সাধারণত প্রকাশ পায় না। বাবা স্বাভাবিক এবং মা হিমোফিলিয়া জীন বহন করলে তাদের সন্তান-সন্ততির ক্ষেত্রে সব মেয়েশিশুই হিমোফিলিয়া জীন বহন করলেও কোনো লক্ষণ প্রকাশ করে না। ছেলেশিশুর ক্ষেত্রে ৫০% সম্ভাবনা থাকে হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার এবং ৫০% সম্ভাবনা থাকে স্বাভাবিকতার।

Advertisement

লক্ষণ: হিমোফিলিয়ার লক্ষণের তীব্রতা নির্ভর করে ফ্যাক্টর ৮ অথবা ফ্যাক্টর ৯ এর পরিমাণের ওপর। যদি এসব ফ্যাক্টরের মৃদু অভাব হয়, সেক্ষেত্রে শুধু শারীরিক আঘাতপ্রাপ্তি বা শল্যচিকিৎসার পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। অন্যদিকে ফ্যাক্টর ৮ অথবা ফ্যাক্টর ৯ এর তীব্র অভাব হলে স্বতঃস্ফূর্ত রক্তক্ষরণ পর্যন্ত হতে পারে। ছেলেশিশুদের খাতনা করার পর অনেকসময় দেখা যেতে পারে যে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না। দুধ দাঁত পড়ার সময়ও অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, শিশু হামাগুড়ি দেওয়ার কারণে হাঁটু ফুলে যায় অথবা সামান্য আঘাতেই গিড়া ফুলে যায়। অনেকসময় নাক থেকে কোনো আঘাত ছাড়া হঠাৎ রক্তক্ষরণ হতে পারে। প্রস্রাব বা মলের সাথেও রক্ত দেখা যেতে পারে। চামড়ার নিচেও রক্তক্ষরণ হয়ে আক্রান্ত স্থানে একাইমোসিস হতে পারে। ভ্যাক্সিন দেওয়ার পর অনেকসময় ধরে রক্তক্ষরণ হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে অস্থিসন্ধিতে রক্তক্ষরণের কারণে অস্থিসন্ধির কর্মক্ষমতা নষ্ট হতে পারে। এছাড়া শরীরের অন্যান্য অংশে এমনকি মস্তিষ্কেও রক্তক্ষরণ হতে পারে, যেটা খুবই মারাত্মক। এতে সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। হিমোফিলিয়ার জটিলতা হিসেবে মাংসপেশীতে এবং অন্যান্য অঙ্গে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ, আর্থ্রাইটিস, ইনফেকশন, চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহৃত ক্লটিং ফ্যাক্টর এর বিরুদ্ধে এন্টিবডি উৎপন্ন হয়ে চিকিৎসার কার্যকারিতা হ্রাসকরণ ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।

প্রতিকার ও চিকিৎসা: গর্ভধারণের আগে জেনেটিক টেস্টিং, গর্ভাবস্থায় কোরিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিং, অ্যামনিওসেনটেসিস, শৈশাবস্থায় রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে হিমোফিলিয়ার উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও অস্থিসন্ধির সুরক্ষার জন্য দৈনন্দিন জীবনযাপনে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলা যেতে পারে। যেমন- ফুটবল, হকি, রেসলিং ইত্যাদি কন্টাক্ট স্পোর্টসে জড়িত না হওয়া, আক্রান্ত ব্যক্তিকে সাঁতার কাটা, সাইক্লিং, হাঁটা-চলা প্রভৃতি ব্যায়ামে উৎসাহিত করা, এস্পিরিন ও আইবুপ্রোফেন জাতীয় ব্যথানাশক ওষুধ যথাসম্ভব পরিহার করা, এন্টি প্লাটিলেট (ক্লপিডগ্রেল) ও এন্টি কোয়াগুলেন্ট (হেপারিন, ওয়ারফেরিন) জাতীয় ওষুধ এড়িয়ে চলা, দাঁতের পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে যত্নবান হওয়া, আঘাতজনিত রক্তক্ষরণ এড়ানোর জন্য নী-প্যাড, এলবো-প্যাড, হেলমেট, সেফটি-বেল্ট প্রভৃতি ব্যবহার করা। রক্তে ফ্যাক্টর ৮ বা ফ্যাক্টর ৯ এর পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য রিকম্বিনেন্ট ক্লটিং ফ্যাক্টর ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ডেসমোপ্রেসিন জাতীয় হরমোন, ক্লট প্রিজার্ভিং মেডিকেশন, ফিব্রিন সিল্যান্টস ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করা যেতে পারে। সামান্য কাঁটা-ছেড়ায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ রোধকল্পে আইস প্যাক ব্যবহার করা যায়। বারবার ফ্যাক্টর ৮ বা ৯ দেওয়ার প্রয়োজন হয় বিধায় রক্ত সঞ্চালনজনিত ইনফেকশন রোধ করার জন্য হেপাটাইটিস এ এবং বি এর ভ্যাকসিন নিতে হবে। হিমোফিলিয়া নিয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে প্রতিবছর ১৭ এপ্রিল ‘বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস’ পালন করা হয়। সময়মতো সুচিকিৎসা ও সচেতনতার মাধ্যমে হিমোফিলিয়ার বিভিন্ন জটিলতা পরিহার করা সম্ভব।

লেখক: এমবিবিএস (ঢামেক), বিসিএস (স্বাস্থ্য), মেডিকেল অফিসার, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ডুমুরিয়া, খুলনা।

এসইউ/এমএস

Advertisement