চীনে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনাভাইরাস আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোমাধ্যমে এর ভয়াবহ পরিস্থিতি কিছুটা আঁচ করা গেলেও চীনা গণমাধ্যমে তার কোনও লক্ষণই নেই। সংক্রমণের ভয়াবহতা তুলে না ধরে ডাক্তার-নার্সদের হৃদয়স্পর্শী কাহিনি শুনিয়েই জনগণকে শান্ত রাখতে চাইছে জিনপিং সরকার। তবে চোখে ধুলো দেয়া হচ্ছে সেখানেও। করোনা সংকটে মেডিকেল কর্মীরাও সুখে নেই, তাদের অনেককেই জোর করে কাজে রাখা হচ্ছে, নেই সংক্রমণ রোধের পর্যাপ্ত পোশাক-মাস্ক-সরঞ্জাম। তবে এসব নিয়ে মুখ খুললেই বিপদ!
Advertisement
মঙ্গলবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, সম্প্রতি চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় গাংশু প্রদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের অজুহাতে ১৪ নারী কর্মীর চুল কেটে দেয় একটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে সরকারপন্থী সংবাদমাধ্যম গাংশু ডেইলি সামাজিক যোগাযোমাধ্যম উইবোতে এ ঘটনার ভিডিও প্রকাশ করে। সংবাদমাধ্যমটি এ ঘটনাকে নারী কর্মীদের সাহসিকতা ও আত্মত্যাগ হিসেবে প্রচার করলেও এ নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনা।
‘প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে নারীর শরীর ব্যবহার বন্ধের’ বিষয়ে লেখা একটি প্রতিবেদন ছড়িয়ে পড়ে চীনা মেসেজিং অ্যাপ উইচ্যাটে। সেখানে অসংখ্য ব্যবহারকারী প্রশ্ন তুলেছেন, এসব নারীকে জোর করে চুল কাটতে বাধ্য করা হয়েছে কি না বা বৈজ্ঞানিকভাবে এর কোনও ভিত্তি আছে কি না।
পরে প্রবল সমালোচনার মুখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ভিডিওটি সরিয়ে নেয় গাংশু ডেইলি। তবে অভিযুক্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, নারী কর্মীরা স্বেচ্ছায় চুল কাটতে রাজি হয়েছিলেন।
Advertisement
নারীদের চুল কাটা নিয়ে সমালোচনার ঝড় মূলত চীন সরকারের প্রোপাগান্ডা ও এ নিয়ে জনগণের মধ্যে বাড়তে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দুই হাজার মানুষ মারা গেছেন এবং ৭০ হাজারের ওপর আক্রান্ত হয়েছেন বলে যে তথ্য দিচ্ছে কমিউনিস্ট সরকার, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে খোদ চীনাদের মনেই। এই ক্ষোভের আগুন নেভাতেই ডাক্তার-নার্স-রোগীদের নায়কোচিত ঘটনাগুলো বেশি করে সামনে আনছে চীনের সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলো। এসবের প্রতিবাদ করে কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখলে বা ‘প্রকৃত অবস্থা’ তুলে ধরলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তার বিরুদ্ধে।
নিয়ন্ত্রিত বাকস্বাধীনতাচীন গুগল, ফেসবুক, টুইটারের মতো মাধ্যমগুলো বন্ধ করে রাখায় দেশটির প্রায় দেড়শ’ কোটি মানুষ উইচ্যাট-উইবো’র মতো স্থানীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই এসব মাধ্যমে সরকারপন্থী ইতিবাচক খবরগুলো নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে, তবে সরকাবিরোধী কিছু লিখলেই সঙ্গে সঙ্গে গায়েব করে দেয়া হচ্ছে সেগুলো।
নানজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও আইন বিভাগের অধ্যাপক গু সু বলেন, চীন ভিন্ন এক সময়ে প্রবেশ করেছে। নিষ্ঠুর ঘটনাগুলো আটকে রেখে ইতিবাচক গল্পের প্রচারণা কাজ করবে না। কারণ মানুষেরা এখনও অন্য জায়গা থেকেও তথ্য পেতে পারে। এই ‘প্রোপাগান্ডা বিভাগ’কে তার কাজের প্রতিফলন দেখাতে হবে।
চলতি মাসের শুরুতে লি ওয়েনলিয়াং নামে এক তরুণ চিকিৎসকের মৃত্যুতে চীনাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। উহান সেন্ট্রাল হসপিটালে চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। গত ডিসেম্বরে লি তার সহকর্মীদের পাঠানো সতর্কবার্তায় সার্সের মতো একটি ভাইরাসের কথা জানান। কিন্তু এর জন্য ‘গুজব ছড়াচ্ছেন’ অভিযোগ করে তাকে সতর্ক করে চীনের জননিরাপত্তা ব্যুরো এবং একটি চিঠিতে সই করতেও বাধ্য করা হয়। পরে নিজ কর্মস্থলে আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে দিতে নিজেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এই চিকিৎসক।
Advertisement
এর পরপরই ক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ মানুষজন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বাকস্বাধীনতার’ দাবি ওঠে জোরেশোরেই। ফলে করোনা সংকটের মধ্যে প্রথমবারের মতো বড় চাপের মুখে পড়ে চীন সরকার। এর প্রেক্ষিতে জনগণকে শান্ত করতে প্রশাসনের শতাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে পদচ্যুত করা হয়। এছাড়া দীর্ঘদিন পর জনসম্মুখে আসেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
হৃদয়স্পর্শী গালগল্পকিছুদিন আগে সাত শীর্ষ নেতাকে ডেকে হৃদয়স্পর্শী গল্পগুলো বেশি করে সামনে আনার পরামর্শ দেন শি জিনপিং। এরপর থেকেই সরকারপন্থী গণমাধ্যমগুলোতে এ ধরনের সংবাদের হিড়িক পড়ে যায়। ‘সরকারের কাজ’-এ সাহায্যের জন্য করোনাভাইরাসের উৎস হুবেই প্রদেশে নামানো হয় তিন শতাধিক সাংবাদিক। সেই থেকে উহান, লুইয়াং, এমনকি দক্ষিণাঞ্চলীয় গুয়াংঝৌ শহরেও ভাইরাসবিরোধী লড়াইয়ে কর্মরতদের ব্যক্তিগত ঘটনাগুলো প্রচার হতে থাকে সমান তালে। এসময় সামনে আসে অন্তঃসত্ত্বা নার্সের দায়িত্বপালন, স্ত্রীর সন্তান প্রসবের সময় জনসেবায় মগ্ন কর্মীর মর্মস্পর্শী ঘটনাগুলো।
কিন্তু মাঠপর্যায়ের বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রায় সব চীনা নাগরিকই রোজ কোনও না কোনও ভাবে নিষেধাজ্ঞার ভুক্তভোগী হচ্ছেন। শুধু হুবেই প্রদেশেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন ছয় কোটি মানুষ। তার ওপর সরকারি গালগল্পগুলো তাদের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে তুলছে।
ব্যর্থ সরকারি প্রোপাগান্ডাহুবেই প্রদেশের রাজধানী ও করোনাভাইরাসের উৎস উহানে মেডিকেল কর্মীদের প্রকৃত অবস্থা খুবই খারাপ। শহরটিতে অন্তত ১ হাজার ১০০ মেডিকেল কর্মী ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছেন। নেই প্রাণঘাতী ভাইরাস মোকাবিলার জিনিসপত্রও। স্থানীয় এক চিকিৎসক জানান, তারা ভাইরাসপ্রতিরোধী স্যুট জোড়া লাগাতে টেপ ব্যবহার করছেন, আর জুতা ঢাকতে কাজে লাগাতে হচ্ছে পলিথিনের ব্যাগ।
এর মধ্যে উহানে এক নার্স গর্ভপাত হওয়ার মাত্র ১০ দিনের মাথায় ফের কাজে যোগ দেয়ার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় তোলে। অনেকেই এটিকে ‘অমানবিকতার বিজ্ঞাপন’ দাবি করে এ ধরনের ‘ব্যর্থ প্রোপাগান্ডা’ ছড়ানো বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।
এছাড়া ‘হৃদয় স্পর্শ’ করতে গিয়ে উল্টো হাস্যরসের ঘটনাও জন্ম দিয়েছে বেশ কিছু কাহিনী। গত সপ্তাহে হুবেই সীমান্তবর্তী শানজি প্রদেশের ২০ দিন বয়সী দুই শিশু তাদের মা (নার্স হওয়ায় হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন) কোথায় জানতে চাচ্ছে বলে খবর বেরিয়েছিল। পরে এ নিয়ে ব্যাপক হাসি-তামাশা ও সমালোচনার মুখে ‘ভুল’ স্বীকার করে সংবাদ সংস্থাটি।
নিয়ন্ত্রিত সংবাদ-আয়োজনকরোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বোঝাতে নতুন পথ ধরেছে চীন। গত সপ্তাহে বেইজিংয়ে ভাইরাস আক্রান্ত থেকে সুস্থ হওয়া কয়েকজন ও তাদের চিকিৎসকদের সাক্ষাৎকার নিতে বিদেশি সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানায় জিনপিং সরকার। সেখানে সুস্থ হওয়া এক ব্যক্তি সাংবাদিকদের বলেন, এই রোগ ততটা ভয়ংকর নয়। আক্রান্ত হলে অবশ্যই দেশ, হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের ওপর বিশ্বাস রাখুন। তারা অবশ্যই আপনাকে সুস্থ করে তুলবেন।
এছাড়া গত সোমবার সাংহাইয়ে শহরের প্রধান করোনাভাইরাস চিকিৎসাকেন্দ্রে অন্তত ৪৫ মিনিট সংবাদ সম্মেলন করে কর্তৃপক্ষ। তবে সেখানে অবরোধ পরিস্থিতি এবং ১০০ শয্যার হাসপাতালটি পুরোদমে চালু করা যাচ্ছে না কেন- এসব বিষয়ে প্রশ্ন করার অনুমতি দেয়া হয়নি।
ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের এসওএএস চায়না ইনস্টিটিউটের পরিচালক স্টিভ স্যাং বলেন, সামান্য সমালোচনার অনুমতি এবং মানবিক গল্পে মনোনিবেশ করার মাধ্যমে তারা মানুষকে আরও বিশদ বিষয় নিয়ে আলোচনা থেকে বিরত রাখছে। এতে চ্যালেঞ্জের মাত্রা ও জনসাধারণের অনুভূতি অত্যাধিক খারাপ হতে পারে।
কেএএ/জেআইএম