কৃষি ও প্রকৃতি

জমজমাট খেজুর গুড়ের হাট, কেজি ৭০ টাকা

জয়রামপুর স্টেশনে আসতেই সারি সারি বাইসাইকেল। গুড়ের কলসি ভর্তি। একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই বলেন, ‘আজ জয়রামপুরের গুড়ের হাট।’ সকাল ১০টার দিকে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের মাঠে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে কৃষকেরা গুড়ভর্তি মাটির কলস (ভাঁড়) নিয়ে এসেছেন। চারিদিকে ম-ম করছে নলেন গুড়ে। ক্রেতা (মূলত গুড় ব্যাপারি) হাতে থাকা লোহার শিক দিয়ে গুড় ও পাটালি ভেঙে মুখে পুরে পরীক্ষা করছেন। দরদাম ঠিক হলেই গুড়ের কলসগুলো মাঠের একপাশে নিয়ে ওজন করে সাজানো হচ্ছে। ওজন করার পর প্রতিটি কলসের গায়ে সাংকেতিক চিহ্ন দেওয়া হচ্ছে।

Advertisement

এখানকার খেজুর গুড়ের সুনাম সারাদেশে। এমনকি বিদেশেও রফতানি হয়। চুয়াডাঙ্গার খেজুরের গুড় ও নলেন পাটালির সুখ্যাতি আছে। স্বাদে-গন্ধেও অতুলনীয়। খেজুর গুড় ও নলেন পাটালি বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে এখন জমজমাট ঐতিহ্যবাহী সরোজগঞ্জ ও জয়রামপুরের সাপ্তাহিক হাট। হাটের দিন এখানে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন ব্যাপারিসহ হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতা।

চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জে দেশের সবচেয়ে বড় খেজুরের গুড়ের হাট বসে। সপ্তাহে দুদিন। শুক্রবার ও শনিবার। আর একটি খেজুরের গুড়ের হাট বসে এ জেলার দামুরহুদা উপজেলার জয়রামপুর গ্রামে। রেলস্টেশন সংলগ্ন। এখানেও সপ্তাহে দুদিন। শনিবার ও মঙ্গলবার। শনিবার তুলনামূলক বেশি জমজমাট হয়। এখন সিজন হওয়ায় হাট জমে উঠেছে। এখানকার খেজুড়ের গুড়ের স্বাদ অতুলনীয়। মানও ভালো। বিদেশেও রফতানি হয়।

গুড়ের বাজার গমগম করছে। যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। খুচরা বিক্রেতা থেকে পাইকারি ব্যবসায়ী কিংবা চাষি থেকে ব্যাপারি সবাই ব্যস্ত। ইজারাদার খাজনা তুলতে ব্যস্ত। হাটের কর্মীরা অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে অতি ব্যস্ত। বাজারজুড়ে কর্মচাঞ্চল্য বেশ লক্ষ্য করার মতই। সাথে রয়েছে কাঁচা শাক-সবজির বাজারও। মাঝেমধ্যে ট্রেনের হুইসেল মাতিয়ে তুলছে হাট এলাকা। লোকাল ট্রেনে গুড়ের ভাড় তুলতে কুলিরা ব্যস্ত। ট্রেনে করে ঐতিহ্যবাহী চুয়াডাঙ্গার গুড় পৌঁছে যাবে উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গে।

Advertisement

সকাল ৮টা থেকেই শুরু হয়ে যায় হাট। দুপুর ১২-১টা পর্যন্ত জমজমাট চলে। এরপর ট্রাক ও ভ্যান বা আলমসাধু ভর্তি হয়ে চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। হাট ঘুরে দেখা যায়, ব্যাপারিরা খুচরা চাষিদের কাছ থেকে গুড় কিনে নেন। চাষি ও ব্যাপারিদের মধ্যে দর কষাকষি করতে দেখলাম। মান অনুযায়ী দাম পেলে চাষিরা গুড় বিক্রি করেন। এরপর ব্যাপারিরা গুড়ের ভাড় (কলসি) নিয়ে জড়ো করেন। তার আগে ওজন করে বিভিন্ন সংকেত লেখেন। এতে বাছাই করতে সুবিধা হয়। এ কাজে জড়িত একজন বললেন, ‘কেনা দামের সাথে যাতায়াত, লেবার ও অন্যান্য খরচ যোগ করে বিভিন্ন বাজারে বা মোকামে বিক্রির জন্য পাঠানো হয়।’

এভাবেই ভাড়ের গায়ে গুড়ের ওজন (পরিমাপ) লেখা হয়। বিভিন্ন গ্রাম থেকে বিভিন্ন সাইজের কলসে গুড় নিয়ে আসেন গাছিরা। ব্রিটিশ আমল থেকেই শনিবার ও মঙ্গলবার বসে বিখ্যাত এ হাট। ফলে ব্রিটিশরা জয়রামপুর রেল স্টেশন নির্মাণ করে। এটি দেশের নির্মিত প্রথম রেলস্টেশনের একটি।

জয়রামপুর গুড়ের হাটের ইজাদার স্বপন বলেন, ‘এ এলাকার খেজুর রসের গুড় ব্যাপক প্রসিদ্ধ। এ গুড়ে কাঁচা রসের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। তাই ব্যবসায়ীদের কাছে আমাদের এলাকার গুড়ের অনেক সুনাম। তাছাড়া শীত মৌসুমে গুড় দিয়ে অনেক পিঠা তৈরি হয়। শীতে কেনা গুড় ব্যবসায়ীরা সারা বছর বিক্রি করে থাকেন। তবে এ ২-৩ মাস প্রচুর কেনাবেচা হয় এ হাটে।’ আশঙ্কার কথাও বললেন তিনি। বলেন, ‘ইটভাটা মালিকরা খেজুর গাছ কিনে পুড়িয়ে ফেলছেন। অনেক গাছি গাছ কাটা বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই এখন আর আগের মতো হাটে গুড় আসছে না। অফ সিজনে গুড়ের পরিমাণ কম থাকে।’

হাটের বেশিরভাগ গুড় বিক্রেতা এসেছেন জয়রামপুর, চাঁদপুর, উকতো, দোস্তসহ চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা থেকে। তাদের বেশিরভাগ নিজেরাই গাছ থেকে রস নামিয়ে খেজুর গুড় তৈরি করেন। আবার কেউ অন্যের খেজুর গাছ ইজারা নিয়ে রস সংগ্রহ করে গুড় উৎপাদন করেন। পাশের কুকিয়া চাদপুরের আলা এ তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন। চাষিরা বলছেন, উৎপাদন খরচ ও শ্রমিকের মূল্য ধরলে সেই তুলনায় গুড়ের দাম কম। দেখা যায়, পাইকারি ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে খেজুর গুড় বিক্রি হচ্ছে।

Advertisement

বগুড়া, সরোজগঞ্জ, কালীগঞ্জ, সাবদারপুরসহ দেশের বিভিন্ন গুড়ের হাটে যান ব্যাপারি মনোর উদ্দিন। তিনি জানান, এখান থেকে গুড় কিনে ঢাকার বিভিন্ন মোকামে পাঠান। এখানকার গুড় খুব বিখ্যাত। বিদেশেও যায় এ হাটের গুড়। তিনি বিভিন্ন বিষয় বিস্তারিত বুঝিয়ে দেন। হাট ঘুরে দেখা যায়, পাইকারি ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে খেজুর গুড় বিক্রি হচ্ছে। মনোর উদ্দিন আরও জানান, বড় কলসির গুড়ের মান তুলনামূলক বেশি ভালো। কেজিপ্রতি কমপক্ষে ৫ টাকা বেশি। মাটির কলসি (বড়) মণপ্রতি ৬ কেজি আর ছোট কলসির ক্ষেত্রে মণপ্রতি ৭ কেজি বাদ দিয়ে নিট গুড়ের পরিমাণ হিসাব করা হয়।

জয়রামপুর স্টেশনসংলগ্ন গুড়ের এ হাটে সহজেই যে কেউ আসতে পারেন। একটু দূরেই দেশের বৃহত্তম গুড়ের হাট। চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ মূল সড়কে সরোজগঞ্জে সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার ও সোমবার গুড়ের হাট বসে। জয়রামপুর হাটের আগের দিন এ ঐতিহ্যবাহী হাটটিও দেখে নিতে পারেন।

লেখক: উপ-পরিচালক, বিআরডিবি, কুষ্টিয়া।

এসইউ/জেআইএম