ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার হাতিবেড় গ্রামে দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমির চাষ প্রকল্পের যাত্রা শুরু করে রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড। ২০০৪ সালে ৭৪টি প্রাপ্তবয়স্ক কুমির নিয়ে যাত্রা শুরু করা এ ফার্মে ছোট-বড় কুমির রয়েছে সাড়ে ৩ হাজার। প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালে জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হিমায়িত কুমির পাঠানোর মধ্যদিয়ে তাদের রফতানি কার্যক্রম শুরু করে। গত ৪ বছরে এ প্রকল্প থেকে ১,২৫৬টি কুমিরের চামড়া রফতানি করা হয়েছে। জার্মানির হাইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১ লাখ ডলারে ৬৯টি হিমায়িত কুমির রফতানি করা হয়।
Advertisement
উদ্যোক্তারা জানান, ২০২১-২২ সাল থেকে প্রতি বছর ১ হাজার কুমিরের চামড়া রফতানি করা সম্ভব হবে। ভবিষ্যতে এ ফার্ম থেকেই কুমিরের মাংস, চামড়া, দাঁত ও হাড় রফতানি করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
খামার কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, চামড়া রফতানির একটি বড় বাজার জাপান। জাপানের বর্তমান বাজারে প্রতি বর্গফুট চামড়া রফতানি হয় প্রায় ১২ ডলারে। একটি কুমির থেকে ৪৫-৫০ ফুট চামড়া পাওয়া যায়। সে হিসেবে একটি কুমিরের চামড়া প্রকারভেদে ৪-৬শ ডলারে বিক্রি করা হয়। গত ৪ বছরে কুমির রফতানি থেকে প্রকল্পটি আয় করেছে ৬০ কোটি টাকার উপরে। বছরে আয় প্রায় ১৫ কোটি টাকা।
সূত্র আরও জানায়, ২০০৩ সালে মেজবাউল হক ও রাজিব সোমসহ কয়েকজন উদ্যোক্তা কুমির চাষ প্রকল্পটি হাতে নেন। নাম দেওয়া হয় রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড। উপজেলার হাতিবেড় গ্রামে প্রায় ১৪ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয় প্রকল্পটি। এরমধ্যে ৪ একর জমির মাটি কেটে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় ১৪টি পুকুর। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে ২০০৪ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। পরে আন্তর্জাতিক সংস্থা সিআইটিইএসের অনুমোদন সাপেক্ষে ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার সারওয়াত থেকে প্রায় সোয়া কোটি টাকা ব্যয়ে আনা হয় ৭৫টি কুমির। কুমিরগুলো পরিবহনের সময় একটি কুমির মারা যায়। তখন কুমিরগুলোর বয়স ছিল ১০-১৪ বছর। লম্বা ছিল ৭-১২ ফুট। আমদানিকৃত কুমিরের মধ্যে ১৫টি ছিল পুরুষ। বর্তমানে এ খামারে কুমিরের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার।
Advertisement
খামারের ব্যবস্থাপক ডা. আবু সাইম মোহাম্মদ আরিফ জানান, কুমিরের প্রজনন মৌসুম এপ্রিল-মে মাস অর্থাৎ বর্ষাকালে। প্রজননের এক সপ্তাহের মধ্যে ডিম দেয়। প্রাপ্তবয়স্ক একটি কুমির গড়ে ৫০-৬০টি ডিম দেয়। ডিম সংগ্রহ করে রাখা হয় আন্তর্জাতিক মানের ইনকিউবেটরে। কারণ বাচ্চা ফোটানোর জন্য আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে সময় লাগে ৮০-৮৫ দিন। ডিম ফুটে কী কুমির জন্ম হবে তা নির্ভর করে তাপমাত্রার উপর। তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রির বেশি হলে পুরুষ বাচ্চা হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হওয়ার পর কিছুদিন ছোট ছোট হাউসে রাখা হয়। যেগুলোকে ধাপে ধাপে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে হ্যাচারিতে স্থানান্তর করা হয়। কয়েক মাস পরিচর্যা করার পর বাচ্চাদের পৃথক পৃথক পুকুরে স্থানান্তর করা হয়। নিয়মিত পরিচর্যায় ৩-৪ বছরেই চামড়া সংগ্রহ করার উপযুক্ত হয়। কুমিরের রোগবালাই নেই বললেই চলে। কুমিরের ছোট বাচ্চাদের প্রতিদিন খাবার দিতে হয়। বাচ্চাদের খাবার হিসেবে দেওয়া হয় মাংসের কিমা। আর বড় কুমিরের খাবার দেওয়া হয় সপ্তাহে একদিন। মুরগির মাংসের পাশাপাশি গরুর মাংস ও মাছ দেওয়া হয় খাবার হিসেবে।
তিনি জানান, বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ৩-৪শ কুমিরের চামড়া বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে। গত ৪ বছরে মোট ১,২৫৬টি কুমিরের চামড়া রফতানি করা হয়েছে। আশা করা যায়, ২০২১-২০২২ সালে এখান থেকে প্রতি বছর ১ হাজার কুমিরের চামড়া রফতানি করা সম্ভব হবে। একেকটি কুমিরের চামড়া প্রকারভেদে ৪-৬শ ডলারে বিক্রি করা হয়। চামড়ার দাম নির্ভর করে আকৃতি ও গুণগত মানের ওপর। সরকারের অনুমতি পেলে দেশ-বিদেশের ফাইভস্টার হোটেলে কুমিরের মাংস বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। তাছাড়া কুমিরের দাঁত, হাড়সহ অন্যান্য অংশ বিদেশে রফতানি করারও পরিকল্পনা রয়েছে খামার কর্তৃপক্ষের।
খামার ব্যবস্থাপক আরও জানান, এ খামারে কুমিরের উৎপাদন প্রতি বছর বাড়ছে। ৭৪টি প্রাপ্তবয়স্ক কুমির নিয়ে যাত্রা শুরু করা এ ফার্মে বর্তমানে ছোট-বড় কুমির আছে সাড়ে ৩ হাজার। স্ত্রী কুমিরের তুলনায় পুরুষ কুমির দ্রুত বাড়ে। তাই পুরুষ কুমিরের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। খামারে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় ৬০ জন কর্মী কাজ করেন। কুমির চাষের কারণে ‘হাতিবেড়’ গ্রামটি ‘কুমিরের গ্রাম’ নামে পরিচিত হয়েছে।
রকিবুল হাসান রুবেল/এসইউ/এমকেএইচ
Advertisement