সাহিত্য

বসন্ত ‘কেশে’ গেছে!

নগরে নিসর্গ বলে একটা কথা আছে। আমাদের পানুভাই ফাগুনের আগমনে যারপরনাই পুলকিত। তার বয়স চল্লিশ উতরেছে। মনে ভাব খুব একটা নেই, চোখে চালশে, খরখরে কণ্ঠ, চামড়ায় রীতিমতো ভাঁজের আওয়াজ। তবে এবারকার ফাগুন তার হৃদয়ে সত্যি সত্যি আগুনের ফুলকি নিয়ে এলো। কারণ নিসর্গ দেখতে পানু একা নয়, দুজন মিলে এসেছে। হালে তার একজন সঙ্গিনীও জুটেছে। বেশ দেখতে।

Advertisement

নীরার সঙ্গে প্রেম, নাকি প্রেম প্রেম ভাব। আচ্ছা, ব্যবসায়ীর মনে কি প্রেম আসে! আসে হয়তো। নইলে খৈল ব্যবসায়ী পানুভাই কি করে বউকে লুকিয়ে ফাগুনের এই প্রথম প্রহরে নীরার সঙ্গে ইন্টুমিন্টু খেলছে! নীরা মেয়ে হিসেবে মন্দ নয়। নীরার নারিত্ব অটুট আছে। বয়ানেও সে বেশ সরেস ও গুণবতী, যাকে বলে ‘লেডি অব গুড হিউমার’। নীরা একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বাংলা পড়ায়।

পানুর সঙ্গে নীরার পরিচয় কী করে হলো! সে এক কাহিনি বটে। বাংলা সিনেমাকেও হার মানায়। তারা দুজন আসলে ‘ছেলেতুত’ সম্পর্কে বাঁধা পড়েছে। দুজনের বাচ্চা একই স্কুলে পড়ে। ছেলেদের আনানেয়ার ফুরসতে টুক করে আলাপটা সেরে নেয় পানু। সে ব্যবসা বোঝে, নারীর মনও বোঝে। ব্যবসা তো আসলে একরকমের আর্ট। টাকা কামানোর শিল্পিত উপায়। বা ধান্ধাও বলা যায়। সে জানে, কী করে সবচে' কম সময়ে নারীর হৃদয় হরণ করলে তা কস্ট-ইফেক্টিভ হয়।

সে যাক, আপাতত ওরা দুজন কোকিলের গান শুনতে আগ্রহী। ইকবাল রোডে ইদানীং বেশকিছু বৃক্ষরাজি হয়েছে। ফলে কোকিলের আচমকা হাঁকডাকও শোনা যায়। পানুর আবার বেশি আবেগে বর্ণবিপর্যয় ঘটে। অকালে কাঁঠাল খেলে যেমন হয় আর কি। সে ফাল্গুন না বলে বলে ফেলল ‘ফুল্গান’। তাতে সশব্দে হাসে নীরা। এর নাম প্রেম। ওটা একবার হয়ে গেলে প্রেমিকের (বা প্রেয়স। প্রেয়সীর লিঙ্গভেদ) ভুলগুলোও ফুলের মতো নিষ্কলুষ ও সুগন্ধী মনে হয়। পানু অবশ্য ভুল করেও ভুল কিছু বলেনি। ফাগুন মানেই তো ফুল আর গানের অপার সমারোহ। দুয়ে মিলে ‘ফুল্গান’। চালিয়াত পানু চট করে নীরার বেলোয়ারি চুড়িসমেত হাতখানা ধরে ফেলল। রবি ঠাকুর পড়ে সে জেনেছে, অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, ওটা ছিনিয়ে নিতে নয়। এমনভাবে খপ করে ধরলো, বেশ মনে আছে ছোটবেলায় শীতের সকালে আমরা এভাবে টাকিমাছ ধরতাম। কী, উপমাটা একটু খটোমটো হয়ে গেল। তা হোক না, মনে ফাগুন এলে রজনীগন্ধার রঙে ওটা রাঙিয়ে নিন। সব কাজ এই লেখককে করতে হবে, এমন দিব্যি কে দিয়েছে বলুন।

Advertisement

নীরা হাত সরিয়ে নেয় না, সে প্রশ্রয় দেয়। সে কেমন বোকা বোকা লাজুক চোখে পানুকে দেখে। হয়তো মনে মনে সে ভাবে, লোকটা তাকে ফাঁসাবে না তো! ওর মনে কোনো কুমতলব! নীরা ইতিউতি দেখে। বোঝার চেষ্টা করে আশেপাশে সিসিসিটি ক্যামেরা লাগানো আছে কিনা। আফটার অল, সে বিবাহিত। পানুর সঙ্গে আনাড়িপনা করতে এসে শেষে স্বামীর ঘর থেকে না বিতাড়িত হতে হয়।

কী দেখছো নীরা! এই, আমাকে দেখো। চুলটা একটু ক্ষয়ে এসেছে বটে, তবে আমি কিন্তু এখনও ফুরিয়ে যাইনি। বুড়ো হতে বহুত দেরি। জানো তো, এজ ইজ নাথিং বাট অ্যা নাম্বার। কায়দা করে একলাইন ইংরেজি শোনায় পানু। সে জানে এদেশিদের ঘাড়ে এখানো ব্রিটিশের ভূত চেপে আছে। রেগে গেলে ইংলিশ ঝাড়ে, আবার নিজের জ্ঞান জাহির করতেও ইংলিশ।

নীরা অনড় থাকে, সে সাথে সাথে কিছু বলে না। পানুকে সে বোঝার চেষ্টা করে, যদিও সে জানে নারী-পুরুষের বয়স চল্লিশ পেরোলে চট করে তাদের বুঝে ওঠা দুষ্কর। এরা তখন জীবনযাৎনায় অস্থির, পোড়খাওয়া মানুষ। অভিজ্ঞও বটে। টিনেজারদের মতো যা কিছু একটা বলে তাদের মনের শাম্পানে পাল তুলে দেয়া যায় না। আচ্ছা, লোকটা তাকে যেভাবে কনভেন্স করার (সোজা বাংলায় পটানো) চেষ্টা করছে, পটে গেলে শেষে আবার গাছে তুলে মই কেড়ে নেবে না তো। বা কৌশলে তার হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে দিল! এসবই তো হচ্ছে এখন। প্রেমের নামে পারফরমিঙ আর্ট। না না, খুব বেশি খোলতাই হওয়া যাবে না, তাতে সমূহ বিপদ। রেখেঢেকে ডিফেনসিভ খেলতে হবে, তাতে কোকিল ডেকে ডেকে যতই তার মাথা খারাপ করুন না কেন। পাখির আর কি! ও তো নীরার মগজ ঘেঁটে দিয়েই অন্য ডালে উড়ে যাবে। নীরা তখন নরক যন্ত্রণায় জ্বলবে।

পানু বেশ মুন্সীয়ানার সুরে বলল, আমি জানি তুমি কী ভাবছো নীরা! আমি চাইনিজ প্রোডাক্ট কিনা, তাই তো! মানে তোমাকে মাঝ রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে ভেগে যাবো না তো। নো নো নীরা, তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। কারণ আমাদের দুজনের অবস্থা এক। নিত্য ডালভাত খেয়ে খেয়ে জিভে চড়া পড়ে গেছে, তাই একটু মুরগি-ভাতের সন্ধান আর কি। বলতে পারো অনেকটা ‘উইন উইন’ সিচুয়েশন। তাহলে আর আমরা একে অপরকে মিছে প্যারায় রাখবো কেন! লস তো কিছু হচ্ছে না। বুঝিয়ে বলে খৈল-কারবারি পানু।

Advertisement

মিটি মিটি হাসে নীরা। পানুর কথাটা তার বেশ মনে ধরেছে। তাই তো, নিত্য সেই এক চেহারা, একই কণ্ঠস্বর, কোনো দোলাচল নেই। স্বামী তো নয়, যেন আসামি একটা। নীরার বর আজকাল খুব বুদ্ধি শিখেছে। বউয়ের কথায় সে একদম ‘চোপা’ করে না। চুপচাপ মেনে নেয়। তার মানে অফিসে সময়টা তার বেশ ভালোই কাটে। সুন্দরী পিএ জুটেছে কিনা কে জানে! পুরুষমাত্রই পলিগ্যামিস্ট। বাস্তবে করে উঠতে না পারলেও মনে মনে সে ঠিকই একাধিক নারীর প্রণয় কামনা করে। করবেই। চরিত্র শব্দটি বস্তুত পুরুষের সঙ্গে একদম যায় না। যে কিছু করে না, আদতে সে কুলিয়ে উঠতে পারে না, যোগ্যতা বা সাহসের অভাব। না পেয়ে চরিত্রবান যাকে বলে। ভাববেন না এটা আমার বাণী। লিখেছেন ওপার বাংলার নন্দিত লেখক দিব্যেন্দু পালিত।

কী হলো, কিছু বলো নীরা। মিছে নৈশব্দ্যের উপাসনা কেন। দেখো, কোকিল কেমন কু কু করে ডেকে যাচ্ছে। সেজেছে প্রকৃতি। যেন শুধু আমাদেরই জন্য।

নীরার অমন আরোপিত ন্যাকামি পছন্দ নয়। পুরুষ হবে সিংহের মতো। নেকু নেকু টাইপ পুরুষমানুষ নীরার ভীষণ অপছন্দ। তাই বলে কি পুরুষের মনে প্রেম পয়দা হবে না। হবে, নিশ্চয়ই হবে। তবে তাতে একটা ছিরিছাঁদ থাকা চাই। রুচিশীল মেয়েরা তল্পিবাহক টাইপ ছেলে মোটেও পছন্দ করে না। যারা কিনা আজ্ঞাবহ গাধার মতো যা বলে তাই মেনে নেয়।

আরো কিছুক্ষণ যায়। নীরা কী বলবে ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারে না। লোকটাকে সে গিলবে নাকি ওগড়াবে, তাই ভাবছে নীরা। আসলে ওর দিলে প্রেম আছে ঠিক, তবে সাহস নেই। সে অকারণ গলা খাকারি দেয়। ফলস কল। তাকে নকল করে কাশে খৈল ব্যবসায়ী পানু। বা ধরুন সঙ্গত দেয়। পানু ওর পকেট থেকে দুটো গোলাপ বের করে আনে। এর নাম পান্তুর গোলাপ, মানে রঙটা তত উজ্জ্বল নয়, কিছুটা হলুদাভ। নিষিদ্ধ প্রেমের মতোন।

নীরা আবার কাশে, পানুও। ওদের দৃষ্টি একে অপরের উপর গভীরভাবে নিবদ্ধ। ওরা একটা গাছের নিচে এসে থানা গাড়ে। হঠাৎ কী একটা দেখে পানুর কাশাকাশি বেড়ে যায়। নীরা মানে বুঝতে না পেরে চোখের ভুরু নাচায়। পানুর চোখে সে প্রেমের পরিবর্তে আতঙ্ক দেখতে পায়। যেন সেখানে ভিমরুলের চাক বাসা বেঁধেছে।

কী ব্যাপার, কী হল! বুঝতে পারে না নীরা। কিছুক্ষণ বাদে তার অবস্থাও তথৈবচ। উল্টো দিক থেকে কেউ একজন এসে নীরার ঠিক সামনে ব্রেক কষে, বা বলা ভালো ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করে। কে সে!

কে আবার! নীরার স্বামী ফায়েজ। আর ওদিকে পানুর ভয়ের কারণ আর কেউ নয়, নীরার মতোই আরেক সোমত্ত নারী, যার সঙ্গে কিনা সতেরো বছর আগে তার নিকাহ্নামা সম্পন্ন হয়েছিল।

দিকদিশে না পেয়ে নীরা ও পানু দুজনেই ডিমপাড়া মুরগির মতো কক্ কক্ করে কাশে, কাশতেই থাকে। যেন মাত্রই ওদের দেখা হয়েছে, এখানেই পরিচয়। তাদের মাঝে এলোমেলো কেস-কারবার কিছু নেই। নীরার স্বামী কী বুঝলেন কে জানে, তবে পানুর স্ত্রী তার স্বামী নামক আসামিটিকে বিলক্ষণ চেনেন। তিনি পানুকে একরকম ‘পরের খেতে মুখ দেয়া’ গরুর মতো খেদিয়ে নিয়ে বাসায় চললেন।

এএ